তেলাপিয়া মাছ
তেলাপিয়া

তেলাপিয়া মাছের বাণিজ্যিক চাষ

একক বা মিশ্র পুরুষ তেলাপিয়ার (Mono-Sex Tilapia) চাষ ইতোমধ্যেই মৎস্যচাষি এবং সাধারণের মাঝে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। সহজ ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে চাষের মাধ্যমে ৪-৬ মাসে শতাংশ প্রতি ৪০-৬০ কেজি তেলাপিয়া মাছ উৎপাদন করা যায়। তেলাপিয়া মাছ পুকুরে ডিম দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করে। ফলে পুকুরে পোনার আধিক্য সৃষ্টি এবং মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এজন্য পুকুরে মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়া চাষ করা হয়। পুরুষ তেলাপিয়ার বৃদ্ধির হার স্ত্রী তেলাপিয়া অপেক্ষা ৩০% বেশি হওয়ায় মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়ার চাষ ক্রমশ লাভজনক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

উৎপাদন পদ্ধতি

পুকুর প্রস্তুতি (ভৌত ও জৈব)
পাড় ও তলদেশ : পাড়ে ঝোপঝাড় থাকলে পরিষ্কার করতে হবে। পানিতে যথেষ্ট পরিমাণে (কমপক্ষে দৈনিক ৮ঘন্টা) সূর্যালোক প্রবেশের সুবিধার্থে সম্ভব হলে বড় গাছ অথবা সম্ভব না হলে গাছের ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন করে পুকুরের পাড় মেরামত ও তলদেশ অতিরিক্ত কর্দমমুক্ত করে সমান করতে হবে। অন্যথায় পুকুরের পানির গুণাগুণ দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া তলদেশ সমান না হলে পরবর্তীতে মাছ আহরণ করা দুরূহ হবে। এ কাজটি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সম্পাদন করাই উত্তম।
জলজ আগাছা এবং রাক্ষুসে ও অন্যান্য মাছ দূরীকরণ : পানি প্রাপ্তিতে সমস্যা না হলে পুকুরের পানি নিষ্কাশন করে অথবা পুকুরে বারবার জাল টেনে যতদূর সম্ভব মাছ ধরে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে প্রতি শতাংশ আয়তন ও প্রতিফুট পানির গড় গভীরতার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম হারে রোটেনন প্রয়োগ করে অবশিষ্ট মাছ ধরে ফেলতে হবে।
চুন প্রয়োগ : চুন প্রয়োগ ও পানি নিষ্কাশন বা রোটেনন প্রয়োগর ২/১ দিন পর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগ : সার প্রয়োগ ও চুন প্রয়োগর ৫-৭ দিন পর প্রতি শতাংশে ইউরিয়া ১০০ গ্রাম ও টিএসপি ১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে ।
পোনা মজুদ:
সময় ও সতর্কতা: সার প্রয়োগের ৪/৫ দিন পর যখন পানির বর্ণ হালকা সবুজ রঙ ধারণ করবে তখন পোনা মজুদ করা যাবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা পুকুরে ছাড়ার সময় পুকুরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য পোনা বহনকারী পাত্রের পানি পুকুরের পানির সাথে কিছুটা সময় নিয়ে অল্প অল্প করে পরিবর্তন করতে হবে যেন পাত্রের পানির তাপমাত্রা ও পিএইচ ক্রমশ পুকুরের পানির সমান হয়ে যায়।
মজুদ হার : প্রায় ১৫ গ্রাম (সম ওজনের প্রায় ৩ গ্রাম) ওজনের ২৫০টি পোনা প্রতি শতাংশে মজুদ করতে হবে। সে হিসেবে ১ একর জলায়তনের পুকুরে মজুদযোগ্য মাছের সংখ্যা হবে ২৫,০০০ টি এবং মোট ওজন ৩৭৫ কেজি এর সাথে অন্যান্য মাছ যুক্ত করা যেতে পারে : সিলভার কার্প ৭০০টি (১০-১৫ সে. মি. আকারের), রুই ২০০টি (৫-৭ সে. মি. আকারের), কাতলা ১০০টি (১৫-২০ সে. মি. আকারের) এবং শিং /মাগুর ২০০-৩০০টি (৫-৭ সে. মি.) অর্থাৎ মোট ১২০০-১৩০০টি অন্যান্য মাছ।

চাষ পদ্ধতি

পুকুর নির্বাচন : বাণিজ্যিক মাছচাষের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পুকুর, ৪০ শতাংশ বা তদূর্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। পানির গভীরতা ৪ থেকে ৬ ফুটের মধ্যে হলে ভাল হয়। মাটি দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ এবং পুকুরটি আয়তাকার হওয়া উত্তম।

পোনা সংগ্রহ :

মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা নিজে উৎপাদন করা সবচেয়ে ভাল। সেক্ষেত্রে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করে প্রতি শতাংশে ১২০০-১৫০০টি (২১-২৪ দিন বয়সের) লিঙ্গ রূপান্তরিত পোনা মজুদ করতে হবে।

প্রতি একরে পোনা মজুদ
প্রজাতি আকার/ওজন সংখ্যা
তেলাপিয়া (মনোসেক্স) ১৩-১৫ গ্রাম ২৫০০০

অন্যান্য চাষযোগ্য প্রজাতি
প্রজাতি আকার/ওজন সংখ্যা
সিলভার ১০-১৫ সে. মি. ৭০০
রুই ৫-৭ সে. মি. ২০০

পোনা মজুদের পর ২৮-৩০% প্রাটিনসমৃদ্ধ খাদ্য নিম্নের সারণি অনুযায়ী প্রতিদিন পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে:
দিন খাদ্য প্রয়োগের হার খাদ্যের প্রকার
১-৭ ৩০% নার্সারি
৮-১৪ ২৫% নার্সারি
১৫-২১ ২০% স্টার্টার-১
২২-২৮ ১৫% স্টার্টার-১
২৯-৩৫ ১২% স্টার্টার-২
৩৬-৪২ ১০% স্টার্টার-২

* পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুৰ্য্য নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন এবং প্রতি সপ্তাহে নমুনায়ন করে পোনার বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। এরূপ ব্যবস্থাপনায় ৬ সপ্তাহ পর ১৫-২০ গ্রাম ওজনের পোনা পাওয়া যাবে। এক একর পুকুরে মজুদের জন্য ২৫ শতাংশ জলায়তনের নার্সারি পুকুর ব্যবহার করতে হবে।

পোনা উৎপাদন করা সম্ভব না হলে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বর্ণিত আকারের প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা সগ্রহ করতে হবে।

সতর্কতা : যে সব হ্যাচারিতে উৎপাদিত তেলাপিয়ার পুরুষ-সংখ্যা শতকরা ৯৮ বা তার চেয়েও বেশি, কেবল সেখান থেকেই পোনা সংগ্রহ করতে হবে। অন্যথায় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যাবে।

মজুদবর্তী সার প্রয়োগঃ প্রতি ১৫ দিনে শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। উল্লিখিত সার দুই ভাগ করে প্রতি সপ্তাহে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাছাড়া পানির রং এর ওপর নির্ভর করে কতদিন পর সার প্রয়োগ করতে হবে তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। সম্ভব হলে প্রতি দিন বা প্রতি সপ্তাহে পরিমিত মাত্রায় সার দেয়া উত্তম।

খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ বাজার হতে তৈরি খাবার কিনে অথবা চাষি নিজে খাবার তৈরি করে পুকুরে প্রয়োগ করতে পারেন। বাজার থেকে তৈরি খাবার ক্রয় করা হলে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তাতে কমপক্ষে ২৮% আমিষ থাকে।
বাজারের খাবারের পরিবর্তে চাষি নিজেই নিম্নোক্ত মিশ্রণ অনুযায়ী পিলেট খাদ্য তৈরি করে তা পুকুরে প্রয়োগ করতে পারেন।

প্রতি ১০০ কেজি খাবারে মিশ্রণ তৈরির জন্য
উপাদান ব্যবহার মাত্রা (%) পরিমাণ (কেজি)
চালের কুঁড়া (অটোমিল) ২৯.৫ ২৯.৫
গমের ভুশি ২০ ২০
ফিশ মিল ২৫ ২৫
সরিষার খৈলি ২০ ২০
চিটাগুড়
ভিটামিন/মিনারেলি ০.৫ ০.৫
মোট ১০০ ১০০

*কোন অবস্থাতেই জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান মাছের খাদ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়।

সতর্কতা : মাছের খাবারের প্রতিটি উপদানের মান গ্রহণযোগ্য হতে হবে। উপাদানসমূহ অথবা মিশ্রিত খাদ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে অন্যথায় নিম্নমানের খাবার প্রয়োগের ফলে উৎপাদন কোন অবস্থাতেই আশানুরূপ হবে না।

খাদ্য প্রয়োগের হার: পোনা মজুদের পর নিম্নের সারণি অনুযায়ী কমপক্ষে ২৮% আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।

সপ্তাহ খাদ্য প্রয়োগের হার খাদ্যের প্রকার
১ম দুই সপ্তাহ ১০% স্টার্টার-২
২য় দুই সপ্তাহ ৮% স্টার্টার-৩
৩য় দুই সপ্তাহ ৭% স্টার্টার-৩
৪র্থ দুই সপ্তাহ ৬% স্টার্টার-৩
৫ম দুই সপ্তাহ ৫% স্টার্টার-১
৬ষ্ঠ দুই সপ্তাহ ৪% স্টার্টার-১
৭ম দুই সপ্তাহ ৪% স্টার্টার-২
৮ম দুই সপ্তাহ ৩% স্টার্টার-২

পরবর্তীতে সর্বশেষে বর্ণিত অর্থাৎ হারে ৩% খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
সপ্তাহে ১ বার নমুনায়ন করে প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। প্রতিদিন উক্ত পরিমাণ খাদ্য সকাল ও বিকেলে দুইবারে সমান ভাগ করে দিতে হবে।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ আর্থিক অপচয়ের পাশাপাশি পুকুরের পানির গুণাগুণের জন্য ক্ষতিকর।

পানির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ : প্রধানত যে বিষয়গুলো পানির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণে বিবেচ্য হলো:
> মজুদপূর্ববর্তী সময়ে পানির রং সবুজাভ হওয়া।
>পরবর্তীতে পানি ঘোলাত্বমুক্ত রাখা ।
>পানির উপরিস্তরে লাল-অ্যালজি বা অতিরিক্ত আয়রনের কারণে লাল রং ধারণ করা এবং সে ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া ।
>সম্ভব হলে, পানির পিএইচ (৭.৫-৮.৫), দ্রবীভূত অক্সিজেন মাত্রা (৫-৭ পিপিএম বা নিযুতাংশ) মেপে দেখা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি।

মাছের অবস্থা পর্যবেক্ষণ :
প্রধান বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো :-
>নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের বৃদ্ধির হার ও তার ভিত্তিতে দেয় খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ।
>সাস্থ্য সংক্রান্ত, বিশেষ করে রোগবালাই-এর উপস্থিতি ও করণীয় নির্ধারণ।

আহরণ ও বিক্রয়
চার মাসে তেলাপিয়াসহ অন্যান্য মাছ বিক্রয় উপযোগী হলে (তেলাপিয়া মাছের গড় ওজন ২০০ গ্রাম অন্যান্য মাছ গড়ে ১,২৫ কেজি)। মাছ ধরার জন্য বেড়জাল/ঝাঁকিজাল ব্যবহৃত হতে পারে। প্রয়োজনীয় পুকুর শুকিয়ে সকল মাছ ধরা যেতে পারে।
প্রাক্কলিত উৎপাদন ব্যয়, সম্ভাব্য মোট আয় ও মুনাফা (১ একর জলায়তনের পুকুরে, ৪ মাসে)।

ব্যয়ের খাত ব্যয় (টাকা)
ইজারামূল্য, পুকুর প্রস্তুতি, রোটেনন, চুন, সার ইত্যাদি): থাকে ৬৫,০০০.০০/-
পোনা ক্রয়ঃ তেলাপিয়া (২৫,০০০টি ও প্রতিটি ২.০০ টাকা) + (অন্যান্য ১২০০টি প্রতিটি ১০.০০ টাকা) ৬২,০০০.০০/-
সার ৬০,০০০.০০/-
খাবার ৭৫০০ কেজি ও টাকা ৪০.০০/- কেজি ৩,০০,০০০.০০/-
অন্যান্য (শ্রমিক, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি) জাল টানা, ঔষধপত্র, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি ৭০,০০০.০০/-
জমানো টাকা ৫৫,৩০০.০০/-
মোট ৫,৫৮,৩০০.০০/-


মাছ চাষ থেকে আয় :
তেলাপিয়া - ৫,০০০ কেজি x টাকা ১১০.০০/-কেজি, আয়: ৫,৫০,০০০,০০ /-
অন্যান্য - ১.৫০০ কেজি x টাকা ১৭০.০০/-কেজি, আয়: ২,৫৫,০০০,০০/-
মোট আয় : ৮,০৫,০০০.০০/-
প্রতি চার মাসে নিট মুনাফা ২,৪৬,৭০০/- টাকা। বৎসরে ২ বার চাষে মুনাফা দ্বিগুণ হতে পারে।

তেলাপিয়ার রোগ ও প্রতিকার:
তেলাপিয়া একটি উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন মাছ। তবে উচ্চ মজুদ ঘনত্ব ও বদ্ধ জলজ পরিবেশে পরিত্যক্ত খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য ও অন্যান্য আবর্জনা পঁচনের ফলে পানি দূষিত হয়ে অনেক সময় রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তেলাপিয়া সাধারণত প্রটোজোয়া জাতীয় পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ অবস্থায় আক্রান্ত পুকুরে প্রতি শতাংশ ২০০-২৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে। অনেক সময় তেলাপিয়া স্ট্রেপ্টোকক্কাস ও অ্যারোমোনাড সেপটিসেমিয়া নামক পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।

*প্রতিমাসে ৩০০গ্রাম পাথরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।

যোগাযোগ করুন



মৎস্য বাংলাদেশ

আমাদের সম্পর্কে
আপনাকে মাছ চাষের তথ্য ও পরামর্শ ওয়েব সাইটে স্বাগতম। আমাদের লক্ষ্য নতুন মৎস্য চাষী তৈরী করা এবং তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করা।

মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।

সংযুক্ত থাকুন

মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।


উদ্ভাবন ও পরিকল্পনায়
হৃদয় জোমাদ্দার

হৃদয় জোমাদ্দার

পরিচালক

মৎস্য বাংলাদেশ

বিস্তারিত

স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।