পেনে মাছ চাষ: একটি বড় জলাশয় বা নদী বা মরা নদী বা তার অংশ বিশেষ, পঠিত অথবা বন্ধ খালের অংশ বিশেষ অথবা হাওর বা বাঁওড়ের কোন বিশেষ অংশকে বেষ্টনী দ্বারা ঘেরাও করে মাছ চাষের উপযোগী করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে একক বা বন্ধ হয়ে চাষ করার কৌশলকে পেনে মাছচাষ বা পেন কালচার বলে। পেনে মাছ চাষের বৈশিষ্ট্য হলো পেনের পানির সাথে বাইরের পানির সংযোগ বা প্রবাহ বিদ্যমান থাকে এবং পেনের বেড়া/জাল জলাশয়ের মাটিতে প্রোথিত থাকে। আমাদের দেশের বিদ্যমান গ্লাবনভূমি, নদীর খাড়ি, বৃহৎ জলাশয়ের অংশ বিশেষ, মরা নদী, বন্ধ মাল এবং পরিত্যাক্ত জলাশয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে পেন সৃষ্টি করে একক মালিকানা কিংবা একাধিক মালিকানার মাধ্যমে মাছ চাষ করা সম্ভব।
পেনে মাছ চাষের গুরুত্ব
■ নিচু ধানক্ষেত, প্লাবনভূমি, নদীর খাড়ি, বৃহৎ জলাশয়ের অংশ বিশেষ, মরা নদী, বন্ধ খাল এবং পরিত্যক্ত জলাশয় পেন কালচার এর আওতায় এনে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।
■ প্রাকৃতিক/বর্ষা প্লাবিত জলাশয়সমূহ উর্বর হয়।
■ এসব জলাশয় প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত রুইজাতীয় মাছসহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও চিংড়ির পোনার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়।
■ প্রাকৃতিক এ সব জলাশয় অধিকাংশ মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
■ বর্ষার সময়কে কাজে লাগিয়ে বাড়তি ফসল হিসেবে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব
■ পতিত/অব্যবহৃত জলাশয়সমূহে পেন কালচার করে জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
■ প্রয়োজনবোধে অল্প সময়ে পেন এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা যায়।
■ একই জলাশয়ে অধিক সংখ্যক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা দূর করা ও অধিক উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
স্থান নির্বাচন
পেনে লাভজনক ভাবে মাছ চাষের জন্য স্থান নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঃ
■ যে সমস্ত জলাশয়ে প্রবল স্রোত বিদ্যমান, তলদেশ এবড়ো-খেবড়ো, দূষিত পানি, ঝড়ো হাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে ও নৌযান চলাচল করে সে সকল জলাশয় পেন তৈরির জন্য উপযুক্ত নয়।
■ নিচু এলাকা যেখানে অন্ততঃ ৬-৮ মাস ৩-১০ ফুট গভীরতায় পানি থাকে।
■ নির্বাচিত এলাকা প্লাবনভূমি হলে শতকরা ১০ ভাগ এলাকায় কিছু নালা/গর্ত/পুকুর/কুয়া থাকলে ভাল হয়।
■ সামাজিক সম্প্রীতি বজায় আছে এবং সম্মিলিতভাবে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে উদ্যোগী/আগ্রহী এমন এলাকা।
■ দুই বা তিনদিকে সড়ক বা বাঁধ আছে এরূপ এলাকা হলে ভাল হয়, তাতে পেন নির্মাণ খরচ কম হবে।
■ নদী/খাল/গীতত্ত্ব/হাওরের অপেক্ষাকৃত কম গভীর এলাকা।
এছাড়াও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লোনা পানিতে বৃহৎ থেরের জমির মালিকানা অনুযায়ী পেন তৈরি করে নিবিড়ভাবে মাছ ও চিংড়ি চাষ এবং হ্র ও বিভিন্ন নদ-নদীর খাড়ি এলাকায় পেন তৈরি করে নিবিড়ভাবে মাছ/চিংড়ি চাষ করা সম্ভব।
পেনের উপকরণ
■ বাঁশের তৈরি বানা বা বেড়া, বাঁশ, জাল ও দড়ি ইত্যাদি খারা পেন তৈরি করা যায়।
■ পেনে খিটবিহীন পলিইথিলিন জাল ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ধরনের জাল বেশি টেকসই।
■ বানা এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন যাতে বানার ফাঁক দিয়ে পানির প্রবাহ সচল থাকতে পারে কিন্তু মাছ চলে যেতে না পারে।
■ গিটবিহীন জাল ৫-৬ বৎসর ব্যবহার করা যায় আবার টায়ার কর্ড জালের আয়ুষ্কাল ২-৩ বৎসর।
■ বানা তৈরির জন্য ব্যবহৃত নারিকেল কয়ের/দড়ি ও সিনথেটিক রশি ১-২ বছর টিকে থাকে। এছাড়া বেড়া বাঁধার জন্য ব্যবহৃত জিআই ভারের আয়ুষ্কাল ১-২ বৎসর।
পেন তৈরি
■ জলাশয়ের গ্রন্থ কম হলে খালের এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে খুঁটি স্থাপন করে বেড়া দিয়ে পেন তৈরি করা যায়।
■ পেন তৈরির জন্য ব্যবহৃত জালের ফাঁস ১০ মি.মি. হলে ভালো হয়। পেন তৈরির সময় নটলেস পলিইথিলিন জাল বা টায়ার কর্ড জাল ব্যবহার করা যায়।
■ জলাশয়ের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে ১.০ হতে ১০.০ হেক্টর আয়তনের যে কোন আকৃতির জলাশয়ে পেন নির্মাণ করা যেতে পারে, তবে ১ হতে ৫ হেক্টর আয়তনের পেনে মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে ভালো।
■ যে এলাকায় পানি প্রবাহ বেশি সেসব এলাকায় বাঁশ দ্বারা উঁচু বানা তৈরি করে তলদেশের মাটির মধ্যে বেশি করে বানা পুঁতে দিতে হবে। পানির চাপে তলদেশের বালি বা নরম মাটি যেন সরে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
মাছ চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা
রাজুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ এবং আগাছা দমন
পেন তৈরির পর জাল টেনে জলাশয় হতে যতদূর সম্ভব রাক্ষুসে মাছ (বোয়াল, আইড, শোল, গজার, টাকি, চিতল, ফলি ইত্যাদি) এবং অবাঞ্ছিত মাছ (বেলে, পুঁটি, পারকিনা, মলা, চাপিলা, চাঁন্দা, ইত্যাদি) ও আঘোচ্ছা (কচুরীপানা, টোপাপানা, কলমীলতা, আড়াইল, হেলেঞ্চা ইত্যাদি) সরিয়ে ফেলতে হবে।
প্রজাতি নির্বাচন
■ মাছের যে সব প্রজাতি পানির সকল স্তরের খাবার খায়। অল্প সময়ে চাষ করে বাজারে বিক্রয় উপযোগী করা যায়।
■ রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, বিগহের কার্প, গ্রাস কার্প,
রাজপুঁটি, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস প্রজাতি মাছ পেনে চাষ করার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তাছাড়া পেনে গলদা চিংড়ি চাষ করাও সম্ভব।
পোনা মজুদ
অধিক ফলনের জন্য সুস্থ ও সবল পোনা নির্দিষ্ট হারে মজুদ করতে হবে। শতাংশ প্রতি পোনা মজুদের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত মিশ্রচাষ পদ্ধতি বিবেচনা
করা যেতে পারে-
খাদ্য স্তর | প্রজাতি | পোনার আকার (ইঞ্চি) | মজুদ ঘনত্ব (সংখ্যা) |
---|---|---|---|
সকল স্তরের তৃণভোজী | গ্রাস কার্প | ৩-৪ | ১-২ |
থাই সরপুঁটি | ৬-৮ | ২-৩ | |
উপরের স্তরের ফাইটো প্লাংকটনভোজী মাছ | সিলভার কার্প বিগহেড কার্প | ৫-৬ | ৪-৫ |
কাতলা | ৬-৮ | ২-৩ | |
মধ্য স্তরের জৈবভোজী মাছ | রুই | ৬-৮ | ৪-৫ |
নিচের স্তরের অর্ধ পচা জৈবভোজী মাছ | মৃগেল | ৬-৮ | ১-২ |
চিংড়ি | ২-৩ | ১০-১২ |
বিঃদ্ৰঃ বর্ণিত মজুদ ঘনত্বটি শুধুমাত্র যে সমস্ত চাষ ব্যবস্থাপনায় নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করা সম্ভবপর হবে সেখানে প্রযোজ্য। খাদ্য প্রয়োগ সম্ভবপর না হলে একর প্রতি মোট সংখ্যা ১২০০-১৫০০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
পোনা মজুদের সম্ভাব্য সময়কাল : মার্চ-এপ্রিল
প্রকৃত উৎপাদনকাল:
জুন-ডিসেম্বর
পেনে মজুদোত্তর মৃত্যুর হার কমানোর জন্য পোনা সরাসরি পেনে না ছেড়ে
অভ্যস্তকরণ করে ছাড়া উচিত।
সব পোনা একই স্থানে না ছেড়ে একই পেনের বিভিন্ন স্থানে ছাড়া উত্তম
পেলে খাদ্য সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা
■ বৃহৎ জলাশয়গুলোতে প্রাকৃতিক খাদ্য প্রচুর থাকলেও শুধু প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করে অধিক উৎপাদন পাওয়া যায় না তাই পেনে মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ১-২% হারে সা করা আবশ্যক।
■ পেনে পিলেট খাদ্য ব্যবহার করা যায় (২৫% প্রোটিন) অথবা
সহজলভ্য সরিষার খৈল, চালের কুঁড়া, ভূমি, আটা, ফিস মিল, চিটাগুড় ইত্যাদির মিশ্রণে খাদ্য তৈরি করে ব্যবহার করা যায়।
■ মাছের বৃদ্ধি ও রোগ-বালাই পর্যবেক্ষণ করার জন্য মাসে কমপক্ষে
একবার জাল টানা প্রয়োজন।
■ প্রতিমাসে একবার মাছের নমুনা সংগ্রহ করে মাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ সমন্বয় করে বর্ধিত হারে খাদ্য প্রয়োগ। করতে হবে।
■ পেনের বেড়া বা জাল মাঝে মাঝে পরিষ্কার করতে হবে এবং কোনরূপ ক্ষতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।
■ অনেক সময় পেনের বেড়া ও জালে ময়লা আবর্জনা জমে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এরূপ অবস্থায় বেড়া ও জাল পরিষ্কার করা না হলে পানির চাপে জাল ছিড়ে যেতে পারে ও বেড়া ভেঙ্গে যেতে পারে।
■ পেনে পোনা মজুদের ৬-৮ মাস পরই মাছ বিক্রিযোগ্য হয়ে থাকে।
যেসব জলাশয়ে সারা বছর পানি থাকে সেসব জলাশয় হতে বাৎসরিক
ভিত্তিতে মাছ আহরণ করা যেতে পারে।
আহরণ ও উৎপাদন
মাছ চাষের উদ্দেশ্য হলো অল্প সময়ের মধ্যে বিক্রিযোগ্য মাছ উৎপাদন করা। জলাশয়ে পানির স্থায়িত্ব ও মাছের প্রজাতি অনুযায়ী বছরে ১-২ বার মাছ আহরণ করা যেতে পারে। পেনে ৬-৮ মাসের মধ্যে বাজারের চাহিদা মত বিক্রিযোগ্য মাছ উৎপাদিত হয়। পেনে পানির স্তর কমতে থাকলে মাছ আহরণ শুরু করা প্রয়োজন। পেনে মাছ চাষ করে বছরে প্রতি হেক্টরে ৮-৯ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
আয়-ব্যয়
এক হেক্টরে পেনে এক বছরে মাছ চাষের আয় ও ব্যয়ের হিসাব
খাত | মূল্য (টাকা) |
---|---|
বানা, বাঁশ, জাল ও দড়ি ইত্যাদি-(২ বছরের ব্যয়) | ১,০০,০০০/- |
মাছের পোনা (প্রতি হাজার ৫,০০০/-) | ১,০০,০০০/- |
মাছের খাদ্য (১০ টন X 80/- প্রতি কেজি) | ৪,০০,০০০/- |
অন্যান্য (শ্রমিক, গার্ড, জালটানা, চুন ইত্যাদি) | ১,০০,০০০/- |
মোট ব্যয় | ৭,০০,০০০/- |
খাত | মূল্য (টাকা) |
---|---|
চাষকৃত মাছ ৯০০০ কেজি (১২০ টাকা/কেজি) | ১০,৮০,০০০/- |
অন্যান্য মাছ ৪০০ কেজি (১০০ টাকা/কেজি) | ৪০,০০০/- |
মোট আয় | ১১,২০,০০০/- |
প্রকৃত মুনাফা (আয়-ব্যয়) | ৪,২০,০০০/- |
পরামর্শ
■ অপরিকল্পিতভাবে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিতে কীটনাশকের প্রয়োগ পেনে মাছ চাষে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই খাল বা সেচ এলাকায় অপরিকল্পিত কীটনাশকের ব্যবহার রোধ করতে হবে।
■ পেনে চাষকৃত মাছের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ বানা, জাল ইত্যাদির
অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ক্ষতিকর জলজ প্রাণী
(যেমন-কাঁকড়া) পেনের জাল যাতে কেটে ফেলতে না পারে সেজন্য
চাষের আগেই খালের কাঁকড়া অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।