নার্সারি
নার্সারি ব্যবস্থাপনা

নার্সারি ব্যবস্থাপনা

নার্সারি লালন পালন

চাষ পদ্ধতি
মাছের রেণুকে প্রয়োজনীয় পরিচর্যার মাধ্যমে লালন পালন করে মজুদ পুকুরে ছেড়ে চারা পোনায় উন্নীত করার পদ্ধতিকে নার্সারি ব্যবস্থাপনা বলে । যে ক্ষুদ্রায়ত জলাশয়ে বা পুকুরে মাছের রেণু অত্যন্ত যত্ন সহকারে লালন করে মজুদ পুকুরে ছাড়ার উপযুক্ত করে বড় করা হয় তাকেই নার্সারি পুকুর বলে। নার্সারি ব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত লাভজনক। মাছ চাষিরা স্বল্প খরচে খুব সহজেই মার্সারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করতে পারে। মাছের রেণু পোনা বড় করার জন্য নার্সারি পুকুরে ৩-৮ সপ্তাহ লালন করা হয়।

রেণু নার্সারির সুবিধাঃ
● সুস্থ সবল পোনা অধিক মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিত করে।
● চাহিদা মত ও সময় মত পোনা প্রাপ্তির জন্য।
● রেণু পোনার মৃত্যুর হার কমানোর জন্য।
● মৌসুমি জলাশয়ের সঠিক ব্যবহার।
নার্সারি ব্যবস্থাপনার বিবেচ্য বিষয় ।
পুকুর নির্বাচন
■ খোলামেলা ও ছোট আয়তাকার।
■ নার্সারি পুকুরের আয়তন ১০-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৩-৪ ফুট হওয়া উত্তম।
■ পানি সরবরাহ ও অপসারণ করার উত্তম ব্যবস্থা।
■তলা অল্প কাদা যুক্ত।
পুকুর প্রস্তুতির ধাপ সমূহ
পুকুর শুকানো
■ উত্তম এবং জরুরি।
■ রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত প্রাণী দূর হবে।
■ ক্ষতিকারক পোকা মাকড়, পরজীবী রোদে শুকিয়ে মারা যাবে।
■ তলার কাদার বিষাক্ততা দূর হবে।
■ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে।
পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে
■ জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
■ শামুকের আধিক্য থাকলে তামাকের গুড়া শতাংশে ৫০ গ্রাম/ফুট হারে ব্যবহার করা যেতে পারে।
■ রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত প্রাণী দূরীকরণ।
■ রাক্ষুসে মাছ দূরীকরণের জন্য রোটেনন ব্যবহার করতে হবে।
■ প্রয়োগ মাত্রা: প্রতি শতকে ৩০-৪০ গ্রাম/২-৩ ফুট পানির জন্য।
নার্সারি পুকুরের চারপাশে নেটের বেড়া স্থাপন ।
জলজ আগাছা পরিষ্কার, রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত প্রাণী নির্মূলের পর বাজারে প্রচলিত সস্তা মিহি ফাঁসের নাইলনের নেট দ্বারা পুকুরের চারপাশে পানির কিনার ঘেষে ২ ফুট উঁচু করে বেড়া দিলে ক্ষতিকারক পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, হাঁসপোকা ইত্যাদির হাত থেকে পোনামাছ রক্ষা পাবে এবং পোনা মাছের বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধি পাবে।
পুকুরে চুন প্রয়োগ
● মাটি ও পানির অম্লত্ব দূর করে।
● চুন পুকুরের তলদেশের জৈব পদার্থকে পচাতে সহযোগিতা করে ফলে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মাটির সৃষ্টিকারক পদার্থ পানিতে মিশিয়ে মাছের খাবার যোগাতে প্রভাবিত করে।
● চুন প্রয়োগে তলদেশের পরজীবী নির্মূল, পানির ঘোলাতু দূরীকরণ ও পানি পরিশোধনের কাজ করে।
চুন প্রয়োগ
● পুকুর শুকিয়ে বা পানিতে শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন দিতে হবে এবং ১-২ দিন পর ৬ ইঞ্চি পানি দিয়ে রাখা ভালো।
● তবে যদি পানি না শুকিয়ে রোটেনন প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তাহলে রোটেনন প্রয়োগের ৪ দিন পর প্রয়োজনীয় মাত্রায় চুন প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগ
প্রাকৃতিক খাদ্য (সবুজ রং phytoplankton আর বাদামী রং zooplankton এর আধিক্য) জন্মানোর জন্য পুকুরে জৈব ও অজৈব সার দিতে হবে।
জৈব সার
প্রতি শতাংশে ১৫০ গ্রাম চিটা গুড়, রাইস পলিশ ২০০ গ্রাম ও ইস্ট ৫ গ্রাম ২-৩ গুন পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
অজৈব সার
■ ইউরিয়া ৫০ গ্রাম/শতাংশ।
■ টিএসপি ১০০ গ্রাম/শতাংশ।
জলজ কীট দমন
চুন ও সার প্রয়োগের ফলে পুকুরে প্লাংকটন সমৃদ্ধ হওয়ায় ৩-৫ দিনের মধ্যে হাঁসপোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
■ এরা পোনা ও পুকুরের খাবার খেয়ে ফেলে
■ পোনার লেজ কেটে ফেলে
* রেণু ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা পূর্বে আকা দমন করতে হবে।
* হাঁসপোকা দমনের উপায় সু তরল রাসায়নিক)
মাত্রা ১০মি.লি./শতাংশ/২-৩ ফুট র জন্য।
সুমিথিওন প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টা পরে রেণু পোনা ছাড়া যাবে।
রেণু পোনা সংগ্রহ
● ভাল জাতের পোনা অধিক উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেয়।
● খারাপ পোনার দৈহিক বৃদ্ধি কম।
● তাই রেণু পোনা ক্রয়ের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক হওয়া উচিত।
● সততা ও সুনাম রয়েছে এমন হ্যাচারি থেকেই কেবল রেণু পোনা।
ক্রয় করা উচিত।
ভাল ও খারাপ রেণু পোনা সনাক্তকরণ।
রেণু পোনা বেঁচে থাকা ও বৃদ্ধির হার ভাল ও খারাপ রেণুর ওপর নির্ভরশীল তাই হ্যাচারি বা অন্য কোন উৎস থেকে রেণু পোনা সংগ্রহের সময় নিম্নের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা আবশ্যক।
ভাল ও খারাপ রেণু পোনা সনাক্তকরণের উপায়

দেখুন বিষয় ভাল রেণু খারাপ রেণু
দেহের রং কালচে বাদামী/সবুজ ও ঝকঝকে উজ্জ্বল ফ্যাকাশে
চলা-ফেরা দ্রুত ও চটপটে ধীরস্থির
রেণুর পাত্রে আঙ্গুল দিল দ্রুত সরে যায় আস্তে আস্তে সরে যায়
স্রোতের বিপরীতে চলাচল অবস্থা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে সক্ষম স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে অক্ষম


রেণু পোনা পরিবহন
● রেণু পোনা পরিবহন করার ২ ঘণ্টা পূর্বে খাবার বন্ধ করা উচিত। পেটে খাবার থাকলে পরিবহনের সময় বমি ও মলমূত্র ত্যাগ করে পানি দূষিত করে ফেললে পোনা মারা যায়।
● পরিবহনের দূরত্ব, পরিবহনের পাত্রের আকার, মাছের আকার এবং পোনার পরিমাণ বিবেচ্য বিষয় ।
● একটি পলিব্যাগে (১৮x৩৬ সে.মি.) পাত্রে ৭-৮ ঘণ্টা সময়ের জন্য ১২৫-১৫০ গ্রাম রেণু পরিবহন করা যায়।
● রেণু পরিবহনের পূর্বে পলিথিন ব্যাগে ছিদ্র আছে কিনা তা যাচাই করা উচিত।
● পলিব্যাগে পানি ও অক্সিজেনের অনুপাত ১:৪ হওয়া উত্তম।
● পলিব্যাগে পানির তাপমাত্রা কম হওয়া উত্তম।
রেণু মজুদের নিয়মাবলী ও সতর্কতা
* রেণু পোনা অত্যন্ত কোমল।
* পানির তাপমাত্রা ও অক্সিজেন বিবেচ্য বিষয়।
* সূর্যোদয়ের পর সকাল বেলা ও সূর্যাস্তের পর পোনা ছাড়া উত্তম।
* কোন কারণে রোদের সময় ছাড়তে হলে পানি ওলট-পালট করে নিতে হবে।
* পলিব্যাগ চটের ব্যাগ থেকে বের করে পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে।
তারপর আস্তে আ হবে।
* ব্যাগের ও পুকুরের পানি ও পযাত্রা সমতার জন্য আস্তে আস্তে পুকুরের পানি ব্যাগে প্রবেশ করাতে হবে এবং তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে।
* তাপমাত্রা সমতায় এলে ব্যাগ কাত করে ধরলে পোনা আপনা আপনিই পুকুরের দিকে যাবে।
* পাড়ের কাছাকাছি রেণু পোনা ছাড়া উত্তম।

এক ধাপে রেণু পোনা প্রতিপালন

এ পদ্ধতিতে রুইজাতীয় মাছের যে কোন প্রজাতির ৪-৫ দিনের রেণু পোনা ২ মাস প্রতিপালন করে ২-৩ ইঞ্চি বড় করা হয়। রেণু মজুদের পরে নিম্নবর্ণিত হারে পুকুরে খাবার সরবরাহ করা উচিত।

দিন খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ খাদ্য প্রয়োগের নিয়ম
১-৩ ১কেজি রেণুর জন্য ২ কেজি ময়দা ৮-১০টি ডিমের কুসুম একত্রে মিশিয়ে দিতে হবে দিনে ২ বার
৪-৭ ১কেজি রেণুর জন্য ৩ কেজি সরিষার খৈল এর দ্রবণ দিনে ২ বার
৮-১০ ১ কেজি রেণুর জন্য ৪ কেজি ভেজা সরিষার খৈল ও কুড়া (২ কেজি কুড়া + ২ কেজি ভেজা সরিষার খৈল) দিনে ২ বার
১১-১৫ ১ কেজি রেণুর জন্য ৫ কেজি খাদ্য দিতে হবে (২.৫০ কেজি কুড়া + ২.৫ কেজি ভেজা সরিষার খৈল) দিনে ২ বার
৮-১০ ১ কেজি রেণুর জন্য ৬ কেজি খাদ্য দিতে হবে (৩ কেজি কুড়া + ৩ কেজি ভেজা সরিষার খৈল) দিনে ২ বার

তাছাড়া পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য বাড়ানোর জন্য রেণু পে ানা মজুদের ১০ দিন অন্তর অন্তর পুকুরে প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনায় এ পদ্ধতিতে ২-৩ মাসের মধ্যে পোনার আকার ৩ ইঞ্চি এবং পোনা বাঁচার হার শতকরা ৬০ ভাগের উপরে।
দুই ধাপে প্রতিপালন
ধাপ-১
■ দুই ধাপে পোনা প্রতিপালন অধিক লাভজনক। এই পদ্ধতিতে ১ম পর্যায়ে প্রস্তুতকৃত আঁতুড় পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সে রেণু পোনা শতাংশ প্রতি ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম করে মজুদ করতে হয়।
■ রেণু পোনা মজুদের পরপরই এক ধাপ পদ্ধতির ন্যায় খাদ্য এবং সার সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে ।
■ এভাবে পুকুরে খাবার ও সার দিলে ৩ সপ্তাহে পোনা ১ ইঞ্চি পরিমাণ বড় হবে।
■ এ পর্যায়ে পুকুরে পোনার জন্য স্থান এবং খাদ্যের অভাব হতে পারে বিধায় পোনা অন্য পুকুরে সরিয়ে ফেলতে হবে। ফলে একদিকে যেমন মাছের দেহ বৃদ্ধি ঘটবে অন্যদিকে পোনার বাঁচার হারও বৃদ্ধি পাবে।
■ উল্লেখিত অধিক ঘনত্বে ২১-২৫ দিন প্রতিপালনে বাঁচার হার শতকরা ৭০-৭৫ ভাগ পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে। এ পর্যায়ে প্রাপ্ত পোনা প্রতিপালনের জন্য বিক্রয়যোগ্য হয়ে থাকে।
ধাপ-২
■ পূর্বোল্লিখিত নিয়মানুসারে পুকুর তৈরি করে ১ ইঞ্চি আকারের ৩৫০০-৪০০০ টি পোনা শতাংশ প্রতি মজুদ করতে হবে।
■ পোনা মজুদের ১ দিন পর থেকে প্রতি লক্ষ পোনার জন্য নিম্নলিখিত হারে সম্পূরক খাদ্য (৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারি খাদ্য) প্রয়োগ করতে হবে।

দিন খাদ্য প্রয়োগের হার
১-১০ দিন ০৮ কেজি
১১-২০ দিন ১০ কেজি
২১-৩০ দিন ১২ কেজি
৩১-৪০ দিন ১৪ কেজি
৪১-৫০ দিন ১৬ কেজি
৫১-৬০ দিন ১৮ কেজি

■ খাদ্য প্রয়োগের পাশাপাশি পুকুরে অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। পোনা মজুদের ১০ দিন অন্তর অজৈব সার যেমন, টিএসপি ৫০ গ্রাম এবং ইউরিয়া ৫০ গ্রাম প্রতি শতাংশ পানিতে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
■ এভাবে প্রতিপালন করলে পোনা ২ মাসে প্রায় ৩ ইঞ্চি আকারের হবে। এভাবে দুই ধাপ পদ্ধতিতে প্রতিপালন করলে পোনা বাঁচার হার প্রায় ৮০ ভাগ পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে ।
রেণু পোনার পরিচর্যা।
■ পানিতে খাবার ও সার দেয়ার তটরেখার ঘাস পরিষ্কার করতে হবে। ব্যাঙ, সাপ, গুইসাপ যেন প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য মিহি ফাঁসের নাইলন নেটের বেড়া দিতে হবে ।
■ পুকুরে খাবার দেবার পর অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করে খাবার কমানো-বাড়ানো যেতে পারে।
■ পানির স্বচ্ছতা ৩০ সে.মি. এর বেশি হলে সার প্রয়োগ করতে হবে।
■ পুকুরের পানি অতিরিক্ত সবুজ হলে খাবার প্রয়োগ বন্ধ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
■ পোনা ছাড়ার ৫ দিন পর থেকে সূর্য উঠার পর ও বিকালে ২-১ বার হররা টানতে হবে।
আহরণ
পোনা মাছ সকাল বেলা আহরণ করা উচিত। অন্যথায় পোনা বাঁচার হার অনেক কমে যাবে। নার্সারি পুকুরে বার বার জাল টেনে অধিকাংশ পোনা ধরে ফেলতে হবে। পরে শুকিয়ে অবশিষ্ট পোনা আহরণ করতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় প্রজাতিভেদে প্রতি কেজি রেণু থেকে নিম্নলিখিত সংখ্যক পোনা পাওয়া যায়।
■ রুই/কাতলা/মৃগেল/ গ্রাস কার্প/মিরর কার্প/কমন কার্প: ২-২.২৫ লাখ
■ সিলভার কার্প/বিগহেড কার্প: ২-২.৫ লাখ
■ রাজপুঁটি: ৩-৩.৫ লাখ
নার্সারি পুকুরে পোনার বাঁচার হার গড়ে ৬০-৮০% পর্যন্ত হয়ে থাকে।



মৎস্য বাংলাদেশ

আমাদের সম্পর্কে
আপনাকে মাছ চাষের তথ্য ও পরামর্শ ওয়েব সাইটে স্বাগতম। আমাদের লক্ষ্য নতুন মৎস্য চাষী তৈরী করা এবং তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করা।

মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।

সংযুক্ত থাকুন

মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।


উদ্ভাবন ও পরিকল্পনায়
হৃদয় জোমাদ্দার

হৃদয় জোমাদ্দার

ঢাকা, বাংলাদেশ।

[email protected]

স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।