লিঙ্গ রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত পুরুষ তেলাপিয়ার (Mono Sex Tilapia) চাষ ইতোমধ্যেই মৎস্য চাষি এবং সাধারণের মাঝে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। সহজ ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে চাষের মাধ্যমে ৪-৬ মাসে শতাংশ প্রতি ৪০-৬০ কেজি তেলাপিয়া মাছ উৎপাদন করা যায়। উপযুক্ত পরিবেশে একই পুকুরে ২-৩ বার তেলাপিয়ার চাষ করা যায়। পুরুষ তেলাপিয়ার বৃদ্ধির হার স্ত্রী তেলাপিয়া অপেক্ষ ৩০% বেশি হওয়ায় মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়ার চাষ ক্রমশ লাভজনক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
পুকুর প্রস্তুতি
■ পুকুর পাড়ে ঝোপঝাড় থাকলে পরিষ্কার করতে হবে।
পানিতে যথেষ্ট পরিমাণে (কমপক্ষে দৈনিক ৮ ঘন্টা) সূর্যালোক প্রবেশের সুবিধার্থে সম্ভব হলে বড় গাছ অথবা সম্ভব হলে গাছের ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন করে পুকুরের পাড় মেরামত ও তলদেশ অতিরিক্ত কাঁদা মুক্ত করে সমান করতে হবে। অন্যথায় পুকুরের পানির গুণাগুণ দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে পারে। তলদেশ সমান না হলে পরবর্তীতে মাছ আহরণ করা
দুরূহ হবে। এ কাজটি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে
সম্পাদন করাই উত্তম।
জলজ আগাছা এবং রাক্ষুসে ও অন্যান্য মাছ দূরীকরণ
■ পানি প্রাপ্তিতে সমস্যা না হলে পুকুরের পানি নিষ্কাশন করে সব জলজ আগাছা এবং রাক্ষুসে ও অন্যান্য মাছ অপসারণ করতে হবে।
■ পানি প্রাপ্তিতে সমস্যা হলে, পুকুরে বারবার জাল টেনে
যতদূর সম্ভব মাছ ধরে ফেলতে হবে।
■ প্রয়োজনে প্রতি শতাংশ আয়তন ও প্রতিফুট পানির গড় গভীরতার জন্য ২০-৩০ গ্রাম হারে রোটেনন প্রয়োগ করে অবশিষ্ট মাছ ধরে ফেলতে হবে।
চুন প্রয়োগ
পানি নিষ্কাশন বা রোটেনন প্রয়োগের ২/৩ দিন পর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগ
চুন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর প্রতি শতাংশে ইউরিয়া ১০০ গ্রাম ও টিএসপি ১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।
পোনা সংগ্রহ
■ মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা নিজে উৎপাদন করা। সবচেয়ে ভাল। সেক্ষেত্রে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করে প্রতি শতাংশে ১২০০-১৫০০টি (২১-২৪ দিন বয়সের) মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা মজুদ করতে হবে।
■ পোনা মজুদের পর ২৮-৩০% প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য নিম্নের সারণি অনুযায়ী প্রতিদিন পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে:
দিন | খাদ্য প্রয়োগের হার | খাদ্যের প্রকার |
---|---|---|
১-৭ | ৩০% | নার্সারি |
৮-১৪ | ২৫% | নার্সারি |
১৫-২১ | ২০% | স্টার্টার-১ |
২২-২৮ | ১৫% | স্টার্টার-১ |
২৯-৩৫ | ১২% | স্টার্টার-২ |
৩৬-৪২ | ১০% | স্টার্টার-২ |
■ পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্য নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন এবং প্রতি সপ্তাহে নমুনায়ন করে পোনার বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। ■ এরূপ ব্যবস্থাপনায় ৬ সপ্তাহ পর ১৫-২০ গ্রাম ওজনের পোনা পাওয়া যাবে। এক একর পুকুরে মজুদের জন্য ২৫ শতাংশ জলায়তনের নার্সারি পুকুর ব্যবহার করতে হবে। পোনা উৎপাদন করা সম্ভব না হলে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে নির্দিষ্ট আকারের প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
সতর্কতা
যে সব হ্যাচারিতে উৎপাদিত তেলাপিয়ার পুরুষ-সংখ্যা শতকরা ৯৮ বা তার চেয়েও বেশি, কেবল সেখান থেকেই ন্যূনতম ১৫ গ্রাম ওজনের পোনা সংগ্রহ করতে হবে। অন্যথায় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যাবে।
মজুদ হার
■ ন্যূনতম ১৫ গ্রাম ওজনের ২০০-২৫০টি মনোসেন্স তেলাপিয়া পোনা প্রতি শতাংশে মজুদ করতে হবে।
■ সে হিসেবে ১ একর জলায়তনের পুকুরে মজুদযোগ্য মাছের সংখ্যা হবে ২০,০০০-২৫,০০০ টি, এর সাথে অন্যান্য মাছ যুক্ত করা যেতে পারে: সিলভার কার্প ৭০০টি, রুই ২০০টি, কাতলা ১০০টি এবং শিং/মাগুর ২০০-৩০০ টি অর্থাৎ মোট ১২০০-১৩০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
■ প্রতি কেজিতে ৪-৫ টি হয় এমন আকারের সিলভার কার্প,
রুই ও কাতলা মাছ এবং ৫-৭ সেমি আকারের শিং/মাগুর
মাছ মজুদ করা যেতে পারে।
এছাড়াও মনোসেক্স তেলাপিয়ার সাথে অন্যান্য মাছ হিসাবে পাঙ্গাস ও শিং/মাগুর মাছ মজুদ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে মনোসেক্স তেলাপিয়া ১০০-১৫০ টি এবং পাঙ্গাস ৫০-১০০ টি এবং ২-৫ টি শিং/মাগুর মজুদ করা যেতে পারে।
সময় ও সতকর্তা
■ সার প্রয়োগের ৪/৫ দিন পর যখন পানির বর্ণ হালকা সবুজ
রং ধারণ করবে তখন পোনা মজুদ করা যাবে।
■ প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা পুকুরে ছাড়ার সময় পুকুরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য পোনা বহনকারী পাত্রের পানি পুকুরের পানির সাথে কিছুটা সময় নিয়ে অল্প অল্প করে পরিবর্তন করতে হবে যেন পাত্রের পানির তাপমাত্রা ক্রমশঃ পুকুরের পানির সমান হয়ে যায়।
মজুদ পরবর্তী সার প্রয়োগ প্রতি ১৫ দিনে শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে উল্লিখিত সার দুই ভাগ করে প্রতি সপ্তাহে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
খাদ্য প্রয়োগের হার পোনা মজুদের পর নিম্নের সারণি অনুযায় কমপক্ষে ৩০% আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগ করতে হবেঃ
সপ্তাহ | খাদ্য প্রয়োগের হার | খাদ্যের প্রকার |
---|---|---|
১ম দুই সপ্তাহ | ১০% | স্টার্টার-২ |
২য় দুই সপ্তাহ | ৮% | স্টার্টার-৩ |
৩য় দুই সপ্তাহ | ৭% | স্টার্টার-৩ |
৪র্থ দুই সপ্তাহ | ৬% | স্টার্টার-৩ |
৫ম দুই সপ্তাহ | ৫% | গ্রোয়ার-৪ |
৬ষ্ঠ দুই সপ্তাহ | ৪% | গ্রোয়ার-৪ |
৭ম দুই সপ্তাহ | ৪% | গ্রোয়ার-৪ |
৮ম দুই সপ্তাহ | ৩% | গ্রোয়ার-৪ |
পরবর্তীতে সর্বশেষে বর্ণিত হারে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য কমপক্ষে প্রতিমাসে ১ বার নমুনায়ন করে প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। প্রতিদিন নির্ধারিত পরিমাণ খাদ্য সকাল ও বিকেলে দুইবারে সমানভাগ করে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
তেলাপিয়ার রোগ ও প্রতিকার
তেলাপিয়া একটি উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মাছ। তবে উচ্চ মজুদ ঘনত্ব ও বদ্ধ জলজ পরিবেশে পরিত্যক্ত খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য ও অন্যান্য আবর্জনা পচনের ফলে পানি দূষিত হয়ে অনেক সময় রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তেলাপিয়ার সাধারণ কয়েকটি রোগ তার প্রতিকার নিয়ে বর্ণনা করা হলো ঃ
ক্ষতরোগঃ মাছের ত্বকে লাল ঘা এবং পরে পুঁজের মতো দেখা যায়। প্রতিকারের জন্য শীতের আগেই পুকুরে (৩.৫ ফুট গভীরতার জন্য) শতাংশে ২৫০ গ্রাম চুন ও ২৫০ গ্রাম লবণ অথবা ৫০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তীতে উল্লেখ্য মাত্রার অর্ধেক একমাস পরপর (শীতকাল শেষ হওয়ার পর) প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
কলামনারিস (ব্যাকটেরিয়া সংক্রমন)ঃ প্রথম দিকে মাছের মাথা, ত্বক, ফুলকা ও পাখনায় সাদা দাগ দেখা যায়, পরে সাদা দাগ গুলো লাল অংশ দ্বারা ঢেকে যায়। প্রতিকারের জন্য এন্টিবায়োটিক আক্সিটেট্রাসাইক্লিন ৫০-৭৫ মিগ্রা/প্রতি কেজি মাছ হিসাবে ৫-১০ দিন খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
স্ট্রেপটোকক্কাস (ব্যাকটেরিয়া সংক্রমন)ঃ পায়ুপথ ফ্যাকাসে লাল, চোখ ও মাংশপেশী লালচে বর্ণ, মাছ খাড়াভাবে বৃত্তাকার সাঁতার কাটতে দেখা যায়। প্রতিকারের জন্য এন্টিবায়োটিক ইরাইথ্রোমাইসিন ৫০ মিগ্রা/কেজি মাছ হিসাবে ৪-৭ দিন পর্যন্ত খাবারে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
ছত্রাকজনিত রোগঃ মাছের চোখ ও মুখ ঘোলাটে এবং অনেকটা তুলার মতো দেখা যায়। এতে মাছ খুব দ্রুত মারা যায়। প্রতিকারের জন্য ১০ লিটার পানিতে ২০০-২৫০ গ্রাম লবণ অথবা ১ চা চামচ পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশিয়ে মাছকে গোসল করাতে হবে।
আহরণ ও বিক্রয়ঃ চার মাসে তেলাপিয়াসহ অন্যান্য মাছ বিক্রয় উপযোগী হবে ( তেলাপিয়া মাছের গড় ওজন ২০০-২৫০ গ্রাম অন্যান্য মাছ গড়ে ৮০০-১১০০ গ্রাম হবে)। মাছ ধরার জন্য বেড়জাল/ঝাঁকিজাল ব্যবহৃত হতে পারে। প্রয়োজনে পুকুর শুকিয়ে সকল মাছ ধরা যেতে পারে।
প্রাক্কালিত উৎপাদন ব্যয়, সম্ভাব্য মোট আয় ও মুনাফা |
---|
ব্যায়ের খাত | ব্যায় (টাকা) |
---|---|
ইজারামূল্য, পুকুর প্রস্তুতি, রোটেনন, চুন, সার ইত্যাদি): থোক | ৬৫,০০০/- |
পোনা ক্রয়ঃ তেলাপিয়া (২৫,০০০টি × গড়ে ২.০০) + (অন্যান্য মাছ ১২০০টি × টাকা ২০.০০) | ৭৪,০০০/- |
সার | ৬,০০০/- |
খাবার ৭৫০০ কেজি × টাঃ ৪৮.০০/কেজি | ৩,৬০,০০০/- |
অন্যান্য (শ্রমিক, জাল টানা, ঔষধপত্র, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি) | ৭০,০০০/- |
মোট | ৫,৫৭,০০০/- |
(১ একর জলায়তনের পুকুরে, ৪ মাসে)
মাছ চাষ থেকে আয়:
তেলাপিয়া-৫,০০০ কেজি × টাকা ১১০/কেজি
আয়: ৫,৫০,০০০ টাকা
অন্যান্য মাছ- ১০০০ কেজি × টাকা ১৫০/কেজি
আয়: ১,৫০,০০০ টাকা
মোট আয়: ৭,৫০,০০০ টাকা
প্রতি চার মাসে নিট মুনাফা ১,৭৫,০০০.০০ টাকা। বৎসরে ২ বার চাষে মুনাফা দ্বিগুণ হতে পারে।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।