ভূমিকা :জলাশয়ে পরিবেশ উপযোগী আকারের খাঁচা স্থাপন করে অধিক ঘনত্বে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদনের প্রযুক্তি হলো খাঁচায় মাছ চাষ। খাঁচায় মাছ চাষের প্রচলন সর্বপ্রথম চীনে শুরু হয়। সম্পূরক খাবার প্রয়োগের মাধ্যমে খাচায় তেলাপিয়া ও কমন কার্পের চাষ বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে প্রবাহমান নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। এ অধ্যায় শুরু হয় চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীতে বাণিজ্যিকভাবে সফলতার সাথে খাঁচায় মাছ চাষের মাধ্যমে।
খাঁচায় মাছ চাষের সুবিধা
■ প্রবাহমান নদীর পানিকে যথাযথ ব্যবহার করে বাণিজ্যকভাবে মাছ উৎপাদন করা যায়।
■ মাছের বর্জ্য প্রবাহমান পানির সাথে অপসারিত হয় বিধায়
পানিকে দূষিত করতে পারে না।
■ মাছের উচ্ছিষ্ট খাদ্য খেয়ে নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজাতির প্ৰাচুৰ্য্য বৃদ্ধি পায়।
■ প্রবাহমান থাকায় প্রতিনিয়ত খাঁচার অভ্যন্তরের পানি পরিবর্তন হতে থাকে, ফলে পুকুরের চেয়ে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা
যায়।
খাঁচা স্থাপনের উপযোগী স্থান
খাঁচা স্থাপনের জন্য উপযোগী নদীর এমন অংশ যেখানে একমূখী প্রবাহ কিংবা জোয়ার ভাটার শান্ত প্রবাহ বিদ্যমান।
নদীর মূল প্রবাহ যেখানে তীব্র স্রোত বিদ্যমান সে অঞ্চলে খাঁচা
স্থাপন না করাই সমীচীন।
■ নদীতে ৪-৮ ইঞ্চি/সেকেন্ড মাত্রার পানিপ্রবাহে খাঁচা স্থাপন মাছের জন্য উপযোগী, তবে প্রবাহের এ মাত্রা সর্বোচ্চ ১৬ ইঞ্চি/সেকেন্ড এর বেশি না হওয়া উচিত।
■ মূল খাঁচা পানিতে ঝুলন্ত রাখার জন্য ন্যূনতম ১০ ফুট গভীরতা থাকা প্রয়োজন। যদিও প্রবাহমান পানিতে তলদেশে বর্জ্য জমে গ্যাস দ্বারা খাঁচায় মাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম তথাপি খাঁচার তলদেশ নীচের কাঁদা থেকে ন্যূনতম ৩ ফুট ব্যবধান থাকা আবশ্যক।
খাঁচা স্থাপনের স্থানটি লোকালয়ের নিকটে হতে হবে যাতে সহজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
খাঁচা স্থাপনের স্থান থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হতে হবে। যাতে সহজে উৎপাদিত মাছ সহজে বাজারজাত করা যায়।
খাঁচা স্থাপনের কারণে যাতে কোনভাবে নৌ চলাচলে বিঘ্ন না
ঘটে।
• সর্বোপরি বাঁচা স্থাপনের জায়গাটি এমন হতে হবে যাতে শিল্প বা কলকারখানার বর্জ্য কিংবা পয়ঃনিষ্কাশনের পানি অথবা কৃষিজমি থেকে বন্যা বা বৃষ্টি বিধৌত কীটনাশক প্রভাবিত পানি নদীতে পতিত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে খাঁচার মাছ মারা যেতে না পারে।
জাসমান খাঁচা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
চা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এখন আমাদের দেশে পাওয়া যায়।
উপকরণসমূহের তালিকা নিম্নরূপঃ
■ পলিইথিলিনের তৈরি জাল ( ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি ফাঁসের)।
■ রাসেল নেট (খাদ্য আটকানোর বেড় তৈরিতে)।
নাইলনের দড়ি ও কাছি।
■ কভার নেট বা ঢাকনা জাল (পাখির উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য)।
■ ১ ইঞ্চি জিআই পাইপ (৭০ ফুট প্রতিটি খাঁচার জন্য)।
■ ফ্রেম ভাসমান রাখার জন্য খালি ব্যারেল/ড্রাম (২০০ লিটারের পিভিসি ড্রাম।
■ খাঁচা স্থির রাখার জন্য গেরাপি (Anchor)।
■ ফ্রেমের সাথে বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাঝারি আকারের সোজা বাঁশ।
খাঁচার আকার
■ নদীতে স্থাপনের জন্য বর্তমানে ২০ফুট × ১০ ফুট × ৬ ফুট
আকারের খাঁচা ব্যবহার হচ্ছে।
■ খাঁচা তৈরির জন্য জালগুলোর ফাঁসের আকার ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চির মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এতে সহজে নদীর পরিষ্কার পানি প্রতিনিয়ত খাঁচার ভিতরে সঞ্চালিত হতে পারে।
ফ্রেম তৈরি ও স্থাপন
গাঁচাগুলোর ফ্লেম তৈরি করতে প্রথমে ১ ইঞ্চি জিআই সাইপ দ্বারা আয়তাকার ২০ ফুট × ১০ফুট ফ্রেম তৈরি করা হয়।
আর মাঝে ১০ ফুট আরেকটি পাইপ বসিয়ে ঝালাই করে ফ্রেম তৈরি করা হয়। এতে একটি ফ্রেমে সরাসরি ২০ফুট × ১০ফুট আকারের খাঁচা বসানো যায় আবার প্রয়োজনবোধে ১০ফুট × ১০ ফুট আকারের দুইটি খাঁচাও বসানো যায়।
প্রতি দুই ফ্রেমের মাঝে ৩টি ড্রাম স্থাপন করে সারিবদ্ধভাবে
ফ্রেমগুলো স্থাপন করা হয়।
● প্রয়োজনীয় সংখ্যক গেরাপী বা নোঙর দিয়ে খাঁচা নদীর নির্দিষ্ট
স্থানে শক্তভাবে বসানো হয়।
• এরপর প্রতিটি ফ্রেমের সাথে পৃথক পৃথক জাল সেট করা হয়। খাচা তৈরির জন্য এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যেন কাঁকড়া, গুইসাপ, কচ্ছপ ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রাণী জালগুলো কাটতে না পারে।
খাঁচায় মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ
■ পানির স্রোত, জালের ফাঁসের আকার, পানির গভীরতা, প্রত্যাশিত আকারের মাছ উৎপাদন, খাদ্যের গুণগতমান এবং বিনিয়োগ ক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করেই মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ করা হয়।
স্থাপিত খাঁচায় প্রতি ঘনমিটারে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০টি পর্যন্ত
মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা মজুদ করা যাবে।
■ মজুদকালে পোনার আকার এমন হতে হবে যাতে পোনা খাঁচা
থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে। ন্যূনতম ৫০-৭৫ গ্রাম ওজনের পোনা মজুদ করতে হবে।
■ মজুদের পূর্বে যথানিয়মে পোনা টেকসই ও শোধন করতে হবে। তা না হলে পোনা মারা যেতে পারে। পোনা মজুদের কাজটি
সকালে অথবা পড়ন্ত বিকালে করতে হবে।
খাঁচায় মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
বাণিজ্যিকভাবে প্রবাহমান পানিতে খাঁচায় মাছ চাষ পরিচালনার জন্য ভাসমান খাদ্যের বিকল্প নেই।
বর্তমানে সারাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে মাছের খাদ্য বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করার জন্য বেশকিছু খাদ্য কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানি পানিতে ভাসমান পিলেট সম্পূরক খাদ্য তৈরি করে থাকে।
মনোসেক্স তেলাপিয়া খাঁচায় মজুদের পর হতে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত তেলাপিয়ার জন্য ২৮-৩০% আমিষ সম্পন্ন খাবার প্রয়োজন।
দৈহিক চাহিদা মোতাবেক নিয়মিত এবং নিয়মমাফিক খাদ্য প্রদান করতে হবে। মাছের ওজন ১০০ গ্রাম হওয়া পর্যন্ত দৈনিক ৩ বার এবং ওজন ১০০ গ্রাম হওয়ার পর দৈনিক ২ বার খাবার প্রদান করতে হবে।
দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ দৈহিক ওজনের ৮-৩ শতাংশ এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।
■ দক্ষতার সাথে ভাল ব্রান্ডের তৈরি ভাসমান খাবার ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, মজুদ থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত এক কেজি তেলাপিয়া উৎপাদন করতে প্রায় ১.২৫ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয়।
খাদ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ না হলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। সুতরাং মাছের খাদ্য চাহিদা যাচাই করে সে মোতাবেক খাবার সিডিউল তৈরি করতে হবে।
■ প্রতি দিন পর পর মাছের নমুনায়ন করে খাবার সিডিউল
পরিবর্তন করতে হবে।
খাঁচায় তেলাপিয়া বাছাইকরণ
প্রত্যাশিত উৎপাদনের জন্য পোনা মজুদের তিন সপ্তাহ পর প্রথম বার খাঁচার মাছ বাছাই করতে হবে।
• দিনের তাপমাত্রার দিকে লক্ষ্য রেখে সকাল বেলা কিংবা পড়ন্ত বিকেলে খাঁচার মাছ বাছাই করা উচিত।
• যখন নদীর পানি বেশি প্রবাহমান থাকে তখন খাঁচার পানি দ্রুত
পরিবর্তিত হতে থাকে। ও বাজারজাত করার পূর্বে প্রয়োজন অনুসারে দুই তিনবার বাছাই করতে হবে।
১০ টি খাঁচার ১টি ইউনিট স্থাপনের সম্ভাব্য
ক্র.নং | উপকরণের নাম | পরিমাণ/ সংখ্যা | একক মূল্য (টাকা) | মোট মূল্য (টাকা |
---|---|---|---|---|
০১ | রেডিমেড জাল | ১০ টি | ৩৫০০.০০ | ৩৫০০০.০০ |
০২ | ড্রাম/ব্যারেল | ২২ টি | ১৫০০.০০ | ৩৫০০০.০০ |
০৩ | ১ ইঞ্জি জিআই পাইপ | ৭৫০ ফুট | ৮৫.০০ | ৬৩,৭৫০.০০ |
০৪ | ফ্রেমেরে সংযোগ লৌহ | ৬৬ টি | ১০০.০০ | ৬৬০০.০০ |
০৫ | গেরাপী (অ্যাষ্কার) | ৩ টি (২০ কেজি প্রতিটি) | ২০০০.০০ | ৬০০০.০০ |
০৬ | গেরাপী বাধাঁর কাছি | ১ কয়েল | ১০০০.০০ | ১০০০.০০ |
০৭ | বাঁশ | ১০ টি | ২০০.০০ | ২০০০০.০০ |
০৮ | নাইলনের সুতা ও রশি | ৫০০০.০০ | ||
০৯ | শ্রমিক মজুরী | ৫০০০.০০ | ||
১০ | অন্যান্য | ৪৬৫০.০০ | ||
১০ টি খাঁচার স্থাপনে মোট খরচ | ১৮০০০০.০০ |
১০ টি খাঁচার এক ফসলের (৬ মাস) উৎপাদন খরচ
ক্র.নং | উপকরণের নাম | পরিমাণ/ সংখ্যা | একক পরিমাণ(টাকা) | মোট মূল্য (টাকা) |
---|---|---|---|---|
০১ | মাছের পোনা সংগ্রহ | ৮,০০০ | ৬.০০ | ৪৮,০০০.০০ |
০২ | মাছের খাদ্য | ৪০০০ টন | ৫৩.০০ | ২,১২,০০০.০০ |
০৩ | শ্রমিক খরচ ছয় মাসের জন্য | ১ জন (৬ শ্রম মাস) | ৫,০০০.০০ | ৩০,০০০.০০ |
০৪ | অন্যান্য | ১০,০০০.০০ | ||
মোট: | ৩,০০,০০০.০০ |
মাছের উৎপাদন
প্রতিটি খাঁচায় একটি ফসলে সর্বনিম্ন উৎপাদন =
৩৭৫ কেজি = ৩,৭৫০ কেজি
১০ টি খাঁচায় (৩৭৫ × ১০)
প্রতি কেজি মাছের পাইকারী বাজারমূল্য
= ১২০ টাকা
মোট মাছ বিক্রয়
= ৪,৫০,০০০ টাকা
= ১,৫০,০০০ টাকা
নীট লাভ = (৪,৫০,০০০-৩,০০,০০০)
(এখানে এককালীন স্থায়ী স্থাপনা খরচ হিসাব করা হয়নি, স্থাপনাটির
আয়ুষ্কাল ৮-১০বছর, প্রতিটি খাঁচার বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা ১টন)
উপসংহার
আমাদের দেশে খাঁচায় মাছচাষের উপযোগী প্রচুর নদ-নদী রয়েছে যেখানে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করে মাছের বাড়তি মাছ উৎপাদন করা যেতে পারে। নদী তীরবর্তী জনগণ বিশেষ করে জেলেরা কেবল নদী থেকে প্রাকৃতিক মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব দরিদ্র জেলেদেরকে সংগঠিত করে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বা সমিতি গঠন করেও খাঁচায় মাছ চাষের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।