ভূমিকা : জনপ্রিয়তা এবং চাষ প্রযুক্তির তুলনামূলক সহজলভ্যতার কারণে কাতলা জাতীয় মাছের চাষ বাংলাদেশে সর্বাধিক। এই মাছের বাজার-চাহিদা সবসময়ই বেশী। ফলে অনেক চাষি কাতলা মাছ চাষে আগ্রহী। মূলত চাষিদের ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে এই মাছের নিবিড় চাষের প্রযুক্তির বিল্পব ঘটেছে। 'চাপের পোনা ' যা সাধারণ পোনার চেয়ে অধিক ঘনত্বে রেখে এক শীতকাল পার করে দিয়ে মজুদ করা হয় তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে এই ধরনের পোনা ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করে চাষিরা অল্প সময়ে অধিক মুনাফা অর্জনে সক্ষম হচ্ছেন। চাষ নিবিড়তার পাশাপাশি “উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলনের” (Good Aquaculture Practices-GAP) মাধ্যমে নিরাপদ মাছ উৎপাদন করে অধিকতর উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রয় করা সম্ভব ।
চাষ পদ্ধতি
পুকুর নির্বাচন : বাণিজ্যিক মাছচাষের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পুকুর, ৪০ শতাংশ বা তদূর্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। পানির গভীরতা ৪ থেকে ৬ ফুটের মধ্যে হলে ভাল হয়। মাটি দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ এবং পুকুরটি আয়তাকার হওয়া উত্তম।
পুকুর প্রস্তুতি
* পাড় ও তলদেশ: পাড়ে ঝোপ-ঝাড় থাকলে পরিষ্কার করতে হবে। পানিতে যথেষ্ট পরিমাণে (কমপক্ষে দৈনিক ৮ ঘন্টা) সূর্যালোক প্রবেশের সুবিধার্থে সম্ভব হলে বড় গাছ কেটে ফেলতে হবে। সম্ভব না হলে অন্তত ভেতর দিকের ডাল-পালা কেটে ফেলতে হবে প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন করে পুকুরের পাড় মেরামত ও তলদেশ অতিরিক্ত কর্মমুক্ত করে সমান করতে হবে। অন্যথায় পুকুরের পানির গুণাগুণ দ্রুত খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া, তলদেশ সমান না হলে পরবর্তীতে মাছ আহরণ করা কঠিন হবে।
* জলজ আগাছা ও অবাঞ্চিত মাছসহ রাক্ষুসে মাছ দুরীকরণ: যদি পানি প্রাপ্তি বিশেষ সমস্যা না হয় তাহলে পুকুরের পানি নিষ্কাশন করে সব জলজ আগাছা এবং অবাঞ্চিত মাছসহ রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করা যেতে পারে। পানি প্রাপ্তি সমস্যা হলে, প্রথমে পুকুরে বারবার জাল টেনে যতদূর সম্ভব সকল মাছ ধরে ফেলতে হবে। এরপর অবশিষ্ট সব মাছ ধরে ফেলার জন্য প্রতিশতক আয়তন ও প্রতিফুট পানির গড় গভীরতার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম হারে রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ৪ ফুট পানির গড় গভীরতার এক একর পুকুরে ১০-১২ কেজি রোটেনন লাগবে।
* চুন প্রয়োগ: রোটেনন প্রয়োগ করা হয়ে থাকলে প্রয়োগর ২/১ দিন পর প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। এই হারে এক একর জলায়তন বিশিষ্ট পুকুরের জন্য চুন লাগবে ১০০ কেজি।
সার | প্রয়োগমাত্রা/শতক |
---|---|
অজৈব সার ইউরিয়া | ১০০-১৫০ গ্রাম |
টিএসপি | ৫০-৭৫ |
*টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করলে ইউরিয়ার প্রয়োগমাত্রা অর্ধেক হবে।
পোনা মজুদ
সময় ও সতর্কতা: পুকুর প্রস্তুতির ৪/৫ দিন পর যখন পানি হালকা সবুজ রং ধারণ করবে তখন পানা মজুদ করা যাবে। চাপের পোনা ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসেই মজুদ করা হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা পুকুরে ছাড়ার সময় পুকুরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য পাত্রের পানি পুকুরের পানির সাথে কিছুটা সময় নিয়ে অল্প অল্প করে পরিবর্তন করতে হবে, যেন পাত্রের পানির তাপমাত্রা ও পি এইচ (pH) ক্রমশ পুকুরের পানির মত হয়ে যায়। এর পর পাত্রের পানিসহ মাছ ধীরে ধীরে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে।
মজুদ হার
*দেশে এখন অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মজুদ হার ব্যবহৃত হচ্ছে, এতে সংখ্যার পাশাপাশি পোনার ওজন ও কম-বেশি হয়। পদ্ধতি ও প্রজাতি ভেদে পোনার আকার ২৫০ গ্রাম থেকে ১.৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। প্যাডল হুইলে বা এ্যারেটরের সাহায্যে পানিতে অক্সিজেন মিশ্রণ ও পানি প্রবাহ তৈরির সুযোগ থাকলে মজুদ হার বাড়ানো এবং বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব।
সফল মজুদহারসমূহের ভিত্তিতে গঠিত চারটি মজুদ মডেল নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
মডেল-১: পোনার ওজন ২৫০-৪০০ গ্রাম |
---|
প্রজাতি | সংখ্যা/বিঘা (৩৩ শতাংশ) | সংখ্যা/একর |
---|---|---|
কাতলা | ১১৫-১৪০ | ৩৪৫-৪৪০ |
সিলভার কার্প | ১৬০-২২০ | ৪৮০-৬৬০ |
রুই | ১৬০-২২৫ | ৪৮০-৬৬০ |
মৃগেল/কালবাউস | ৯০-১০০ | ২৭০-৩০০ |
মোট | ৫২৫-৬৮৫ | ১৫৭৫-২০৬০ |
মডেল-২: পোনার ওজন ২৫০-৪০০ গ্রাম |
---|
প্রজাতি | সংখ্যা/বিঘা (৩৩ শতাংশ) | সংখ্যা/একর |
---|---|---|
কাতলা | ৫০০ | ১৬০০-১৮০০ |
মোট | ৫০০ | ১৬০০-১৮০০ |
* কোন কোন অঞ্চলে শিং, মাগুর শতকে ১৫-১৮টি হারে রুই-জাতীয় মাছের সাথে মিলিয়ে চাষ করা হয়। বাজারজাত করার উপযোগী হয়ে গেলে বড় মাছগুলো ধরে বিক্রয় করে দিয়ে সমসংখ্যক পোনা পুনঃমজুদ করলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে।
পোনার উৎস বাণিজ্যিক মৎস্য খামারের চাহিদা পুরণের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে "চাপের পোনা" মাছের খামার গড়ে উঠেছে। কোন কোন সরকারী মৎস্য খামার বা অন্য কোন ভাল উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে অনেক চাষি নিজেরাই খামারের আলাদা ইউনিটে এই ধরনের বিশেষ পোনা তৈরি করে নিতে পারেন।
খাদ্য ব্যবস্থাপনা
সব মাছ প্রধানত তৈরী সম্পূরক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। খাবার চাষি নিজে তৈরি করে নিতে পারেন অথবা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরা তৈরি পিলেট খাবার ব্যবহার করতে পারেন। মাছের ওজন গড়ে ১.৫ কেজি হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে নমুনায়নের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেহের ওজনের ৩% হারে প্রতিদিন দিতে হবে। এ খাবার সমান দুভাগে ভাগ করে সকাল-বিকাল সমহারে দেয়া যায়। মাছের গড় ওজন ১.৫ কেজির বেশি হয়ে গেলে খাদ্য প্রদান হার ধীরে ধীরে পুকুরে মাছের মোট ওজনের ২.৫% এ নামিয়ে আনতে হবে। নমুনায়নে পনের দিন পরপর মজুদকৃত প্রতিটি প্রজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে করতে হবে। কেবল নির্ভরযোগ্য এবং বিধি বিধান অনুসরণ করে চলা খাদ্য প্রস্তুতকারীর নিকট হতে খাবার ক্রয় করতে হবে। প্রয়োজনে চাষি নিজেও নিমোক্ত ভাবে খাবার তৈরি করে নিতে পাবেন। এতে করে একদিকে যেমন খাদ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করা যাবে তেমনি তা মূল্য সাশ্রয়ী হবে।
* প্রতি ১০০কেজি খাদ্য তৈরিতে বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহার মাত্রা। *
খাদ্য উপাদান | পরিমাণ(কেজি) |
---|---|
চালের কুড়া/গমের ভুশি | ৪৯.৫০ |
সরিষার/তিলের খৈল | ২০.০০ |
ফিশমিল/প্রোটিন কনসেনট্রেটি | ২০.০০ |
আটা | ৫.০০ |
চিটাগুড় | ৫.০০ |
ভিটামিন ও খনিজ | ০.৫০ |
মোট | ১০০ |
বিঃদ্রঃ ভাসমান/ডুবান্ত খাদ্য তৈরি করতে হবে।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় করণীয়
* সংরক্ষিত পিলেট খাদ্য এক মাসের মধ্যে ব্যবহার করে ফেলা উচিৎ। তবে খাদ্যে এন্টি ফাংগাল এজেন্ট/এন্টি-অক্সিডেন্ট ব্যবহার করলে উপযুক্ত পরিবেশে তা ৩-৪ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
* পোনা মজুদের পর প্রতিদিন সকাল-বিকাল মাছের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মেঘলা দিনে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
* পুকুরের পানি কমে গেলে ভাল উৎস হতে পানি সরবরাহ করতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পুকুরের পানি বেড়ে গিয়ে উপচে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে পানি বের করে দিতে হবে।
* সেকি ডিস্কে পানির স্বচ্ছতা ৮ সেন্টিমিটারের নীচে নেমে গেলে খাবার দেয়া বন্ধ থাকবে।
* পানিতে অক্সিজেনের অভাবে মাছ পানির উপরের স্তরে উঠে খাবি খেতে থাকে। এই অবস্থায় পানিতে ঢেউ সৃষ্টি করে/প্যাডেল হুইল বা এ্যারেটর ব্যবহার করে বা অন্য কোন উপায়ে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
*পুকুরের তলায় যাতে বিষাক্ত গ্যাস জমতে না পারে সেজন্য মাঝে মাঝে হররা টানতে হবে।
* জাল টেনে মাঝে মাঝে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
* বিক্রির উপযোগী মাছ ধরে ফেলতে হবে যেন অপেক্ষাকৃত ছোট মাইগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পায়।
* ফেব্রুয়ারী-মার্চে মজুদ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই সব মাছ ধরে ফেলতে হবে।
* বাজার চাহিদার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করা প্রয়োজন।
* ভোর বেলায় মাছ ধরতে হবে।
উৎপাদন
বর্ণিত পদ্ধতিতে একর প্রতি মাছের উৎপাদন ৪-৫ টন পাওয়া সম্ভব।
সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয়, আয় ও মুনাফা (এলাকাভেদে ইজারা মূল্য ও উপকরণ মূল্যের পার্থক্যের জন্য ব্যয়, আয় ও মুনাফা কমবেশী হতে পারে) জলায়তন এক একর, সময়কালঃ ৮-৯ মাস
ব্যয়ের খাত | ব্যয় (টাকা) |
---|---|
ইজারামূল্য, পুকুর প্রস্তুতি, রোটেনন, চুন, সার ইত্যাদি থোকি | ৬০,০০০.০০/- |
পোনা: বিভিন্ন মডেলের গড় থোক (মডেল ভেদে তারতম্য হবে) | ৬০,০০০.০০/- |
খাবার: ৯০০০ কেজি X ৪০ টাকা(নিজস্ব খামারে উৎপাদিত) | ৩,৬০,০০০.০০/- |
অন্যান্য (শ্রমিক, জালটানা, ঔষধপত্র,বাজারজাতকরণ): থোক | ১,০০,০০০.০০/- |
জমানো টাকা | ৩৯,৩৭৫.০০/- |
মোট ব্যয় | ৬,০৯,৩৭৫.০০/- |
আয়: উৎপাদন ৪৫০০ কেজি x ২২৫ টাকা প্রতি কেজি হারে = ১০,১২,৫০০.০০/- টাকা
ব্যয়: = ৬,০৯,৩৭৫.০০/-
মুনাফা= ১১০,১২,৫০০,০০- ৬,০৯৩৭৫.০০ = ৪,০৩, ১২৫,০০/-
উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলনের সাধারণ নিয়মাবলি সর্বক্ষেত্রে সঠিকভাবে মেনে একজন চাষি এ পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারবেন।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।