ভূমিকা : আশির দশকের অপ্রচলিত পণ্য শিলা কাঁকড়া বর্তমানে একটি রপ্তানিযোগ্য অর্থকরী জলজ সম্পদ। উপকূলীয় অঞ্চলের ৭১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের কম-বেশী উপস্থিতি বিদ্যমান। তবে সেন্টামার্টিন স্বাতীত বৃহত্তর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সাতক্ষীরা, খুলনা ও নোয়াখালীসহ মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, হাতিয়া এবং দুবলারচর এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে এদের পাওয়া যায়। আমাদের দেশে লোনা পানিতে ১২ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া গেলেও মাড ক্র্যাব বা শিলা কাঁকড়াই (Seylla serrata) একমাত্র বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা আকারে ও ওজনে বড় হয়। চিংড়ির ন্যায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর চাহিদা ও অধিক মূল্য প্রকৃতিতে পোনার প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতা, সহজে ও অল্প সময়ে বাজারজাত যোগ্য করা যায় বলে চাষীদের কাছে কাঁকড়া চাষ ও ফ্যাটেনিং ক্রমেই জন প্রিয় হয়ে উঠছে। সুন্দরবনের প্যারাবন (Mangrove) বিধৌত মোহনা এলাকায় এদের বসবাস হলেও ডিম ছাড়ার জন্য গভীর সমুদ্রে চলে যায়। ডিম ছাড়ার পর বাচ্চা অবস্থায় অর্থাৎ জুইয়া ও মেগালোপা পর্যায়ে সমুদ্রের অগভীর এলাকায় চলে আসে। এরপর মোহনা ও প্যারাবন এলাকায় পরিপক্কতা লাভের পর পুনরায় গভীর সমুদ্রে চলে যায়। এভাবেই তাদের জীবনচক্র চলতে থাকে।
পুরুষ ও স্ত্রী কাঁকড়া চেনার উপায়
কাঙ্খিত দৈহিক ও জৈবিক গুণাবলি অর্জনের পর আন্তর্জাতিক বাজারে স্ত্রী ও পুরুষ উভয় প্রকার কাঁকড়ারই চাহিদা থাকে। স্ত্রী কাঁকড়ার বেলায় গোনাড ও পুরুষ কাঁকড়ার বেলায় আকৃতি বৃদ্ধিসহ দেহের খোলস শক্ত থাকা দরকার। চিমটা পা ও বুকের ফ্ল্যাপ দেখে স্ত্রী ও পুরুষ কাঁকড়া সহজে চেনা যায়।
স্ত্রী ও পুরুষ কাঁকড়া সনাক্তকারী উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
■ স্ত্রী কাঁকড়ার বুকের ফ্ল্যাপটি অর্ধগোলাকার, অপরদিকে পুরুষ কাঁকড়ার ফ্ল্যাপটি
অপেক্ষাকৃত সরু ও ইংরেজী ইউ বা ভি আকৃতির।
■পুরুষ কাঁকড়ার চিমটা পা একই বয়সের স্ত্রী লঞ্চিতা চাইতে বড় ও ধারালো।
চাষাবাদ পদ্ধতি
বাংলাদেশে সারা বছর ধরে অঞ্চল ও ঋতুতে যান তার ও পরিমাণের কাঁকড়ার পোনা পাওয়া গেলেও জানুয়ারি হতে আগস্ট মাস পর বেশি দেখা যায়। কাঁকড়া অতি দ্রুত বর্ধনশীল রাক্ষুসে স্বভাবের জলজ প্রাণী। এলাকায় পানির লবণাক্ততা বেশি সেখানে উপযুক্ত খাদ্য প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার দু'বার এর চাষ করা সম্ভব। যেসব এলাকায় লবণাক্ততা বেশি থাকে সেখানে এবং লবণাক্ততা কম হলে মার্চ মাসে কাঁকড়া মজুদ করতে হবে।
ঘেরের স্থান নির্বাচন ও প্রস্তুতকরণ
কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে ঘেরের স্থান নির্বাচন, আকার ও আয়তনকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে ।। গবেষণায় দেখা গেছে যে, উপযুক্ত স্থানে খামার গড়ে না তুললে তা লাভজনক হয় না।
ঘের তৈরিতে বিবেচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে:
> বেলে দো-আঁশ বা কাদা মাটি যুক্ত এলাকায় ঘেরের স্থান নির্বাচন করতে হবে। ঘেরের আয়তন ০.২-১.০ হেক্টর হওয়া বাঞ্ছনীয়, এতে ব্যবস্থাপনার সুবিধা হয়
> কাঁকড়া ধীরে ধীরে যখন পরিপক্কতা লাভ করে অর্থাৎ দেহে গোনাড বাড়তে শুরু করে তখন এরা স্রোতে সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। তাই খেয়াল রাখতে হবে পুকুর যেন বেশি ছোট
না হয়। না হলে কাঁকড়া সাঁতার কাটার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এমন স্থানে মের নির্বাচন করতে হবে যেখানে জোয়ার ভাটায় পানি পরিবর্তন করা যায়।
>অর্থাৎ সমুদ্র বা লোনা পানির উৎস আছে এমন নদী বা খালের সাথে ঘেরের সংযোগ থাকতে হবে।
> ঘেরের পানি ঢুকানো নির্গমনের জন্য নিয়ন্ত্রণযোগ্য আলাদা গেইট করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, কাঠের তৈরি ১৭-১৮ ফুট লম্বা (২.০ ফুট চওড়া ও ২.৫ ফুট উচ্চতা) সুইস গেইট ব্যবহার সর্বোত্তম। তাছাড়া পাকা করেও সুইস গেইট তৈরি করা যেতে পারে।
> ঘের শুকিয়ে ভালভাবে চাষ দিতে হবে যাতে উপরিস্তরের মাটি ঝুরঝুরে হয়ে যায় এবং তলদেশে যাতে কমপক্ষে ৪-৫ ইঞ্চি পরিমাণ কাদা থাকে।
> কাঁকড়া মাটির নিচে গর্ভ করে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে এবং এ ধরণের পর্যাতনে জন্য পুরুষের চতুর্দিকে নাইলন নোট বা বাঁশের বানা তৈরি করে ঘেরের পাড়ের চারদিকে পুঁতে (০.৫ মি. নিচে) বসাতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বানার উচ্চতা কমপক্ষে ১৫ মিটার ও বানার ভেতরের কাঠির ফাঁক কোন ক্রমেই যেন ০.৫ সেন্টিমিটার এর বেশি না হয়। এরপর চাষকৃত পুকুরে খনন করে সামান্য পানি উঠিয়ে নিতে হবে যেন তলদেশে সামান্য কাদার সৃষ্টি হয়।
> মাটির পিএইচ এর ওপর ভিত্তি করে চুন দিতে হবে। তবে চুন ও সার প্রয়োগের পূর্বে ৩-৪ বার জোয়ারের পানি ০.৫ মিটার উচ্চ গভীরতা পর্যন্ত ঢুকিয়ে ফ্লাশিং করে পানি আবার বের করে দিতে হবে। এতে করে মাটির অসুত্ব নিয়ন্ত্রণ সহ ক্ষতিকর দ্রব্যাদি অপসারণের সুবিধা হবে। পিএইচ ৭-৭.৫ হলে প্রতি হেক্টরে ১২৫ কেজি পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। নিম্ন মাত্রায় পিএইচ এর ক্ষেত্রে প্রতি ০.১ মান বৃদ্ধির জন্য ৩৫ কেজি/হেক্টর হিসেবে চুন প্রয়োগ করতে হবে। কাঁকড়া চাষের জন্য পিএইচ এর উৎস মাত্রা ৭.৫-৮.৫ উত্তম চুম ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই পানি প্রবেশ করাতে হবে এবং ৭ দিন পর ইউরিয়া ২৫ কেজি/হেক্টর, টি.এস.পি ১৫কেজি/হেক্টর ব্যবহার করতে হবে। সার প্রয়োগের ৩ দিন পর ৭৫০কেজি গোবর/হেক্টর ঘেরে ছিটিয়ে দিতে হবে। গোবর প্রয়োগের ৩ দিন পর পোনা ছাড়তে হবে।
পোনা বাছাই, সনাক্তকরণ ও মজুদ
বাংলাদেশে এখনও প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর কাঁকড়ার পোনা পাওয়া যায়। এরা খুবই শক্ত প্রকৃতির প্রাণী। প্রতিকূল অবস্থায় এমনকি পানি ছাড়াও বাতাসে কমপক্ষে ৪-৫ দিন স্বাভাবিকভাবে এবং বেঁচে থাকতে পারে সেজন্য পোনা ধরার পর হতে খামার পর্যন্ত পরিবহনে তেমন কোন সমস্যা হয় না।
না নির্বাচনকালীন সময়ে যেসব বিষয় গুলো বিবেচনা করতে হবে, সেগুলো হলো
> সকল, সুস্থ পোনা এবং পুরুষ স্ত্রী বাছাই করে সঠিক অনুপাতে মজুদ করতে হবে
(শ্রী: পুরুষ=৯:১) মজুদ কাঁকড়ার গড় ওজন কম পক্ষে ২৫-৩০ গ্রাম হতে হবে। গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে যে, হেক্টর প্রতি ১০,০০০ (দশ হাজার) পোনা এবং স্ত্রী পুরুষ অনুপাত ৯:১ হলে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়।
> কাঁকড়ার পোনা মজুদের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন মোটামুটি একই আকারের হয়। নতুবা খাদ্য প্রতিযোগীতার ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট ও দূর্বল কাঁকড়া বড়দের খাবার হিসেবে ব্যবহার
হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অথবা আঘাত প্রাপ্তির কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে।
খাদ্য প্রয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও আশ্রয়স্থল নির্মাণ
চিংড়ির ন্যায় কাঁকড়াও নিশাচর প্রাণী। তবে এরা জোয়ারের সময় দিনেও সাঁতার কেটে খাদ্য শিকার করে এবং সক্রিয়ভাবে বিচরণ করে থাকে। ছোট অবস্থায় অর্থাৎ শৈশবে এরা ডায়াটিন, ফার, আর্টিমিয়া ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এদের অ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটে। এসময়ে কাঁকড়া তার চিমটা পা দিয়ে জীবন্ত খাদ্য শিকার করে খেয়ে থাকে। মেরে ২৫-৩০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া মজুদ করা হয় বলে এ সময়ে তাদেরকে জীবন্ত খাবার অথবা মাংসালো খাবার সরবরাহ করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজের
বৈষয়গুলো খেয়াল রাখা অত্যাবশক। এমন ভাবে খাবার প্রয়োগ করতে হবে যেন তা চাহিদার তুলনায় কম না হয়। অন্যথায় এবং একে অন্যকে খেয়ে ফেলবে। এক্ষেত্রে একটি ফিডিং ট্রেতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিমাণ
খাবার সরবারাহ করে মাঝে মাঝে খাবারের চাহিদা নিরূপন করে নিতে হবে।
> দ্রুত বৃদ্ধির জন্য শামুক, ঝিনুকের নরম মাংস, ট্রাশ ফিস (তেলাপিয়া), ছোট চিড়ি
চিংড়ির মাথা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
> সাধারণত দৈনিক মোট দেহ ওজনের ৮-১০% হারে খাদ্য সরবরাহ করলেই যথেষ্ট।
সারণি ১. কাঁকড়া চাষে ব্যবহারোপযোগী বিভিন্ন খাবারের পুষ্টিমান (Dry Weight Basis)
উপাদান | আমিষ (%) | ফ্যাট (%) | শর্করা (%) | কিলো ক্যালোরি |
---|---|---|---|---|
চিংড়ির মাথা | ৩৫.৮৮ | ১.০৬ | ৯.৭৩ | ৩৭৭৪ |
ঝিনুকের মাংস | ৩০.৩৯ | ২৩.২৩ | ১০.৮১ | ৫৯৩৯ |
গরুর নাড়িভূড়ি | ৫১.৬০ | ২১.১৪ | ১৩.০৪ | ৫৫২৬ |
তেলাপিয়া | ৫৯.৬ | ৬.০ | ১২.২ | ৫১০০ |
কাঁকড়া চাষের বেলায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরবরাহকৃত খাবারের সূত্র
কাঁকড়া জীবন্ত খাবার পছন্দ করে। তাই খাদ্য হিসেবে ট্রাশ ফিশ (তেলাপিয়া), শামুক/ঝিনুকের
মাংস, গরু/ছাগলের নাড়িভুঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। তবে সরবরাহকৃত খাবারে যেন কমপক্ষে ৩০-৪০% আমিষ থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার। নিম্নে কয়েকটি খাদ্য সূত্র দেয়া হলো।
সারণি ২. কাঁকড়া চাষে ব্যবহারোপযোগী বিভিন্ন খাদ্য উপাদান, হার ও আমিষের পরিমাণ আমিষ(%)
খাদ্য উপদান | ব্যবহারের মাত্রা (%) | সরবরাহকৃত আমিষ (%) |
---|---|---|
সূত্র-১, তেলাপিয়া/বাগদা চিংড়ির মাথার মাংসল অংশ | ৫০/৫০ | ২৯.৫/১৭.৯৪ |
সূত্র-২, তেলাপিয়া/ গরু/ছাগলের নাড়িভুঁড়ি | ২৫/৭৫ | ১৪.৯/৩৮.৭ |
সূত্র-৩, তেলাপিয়া/ শামুক/ঝিনুকের নরম মাংস | ৫০/৫০ | ২৯.৫/১৫.১৯ |
তাছাড়া কাঁকড়া প্রতি অব্যবস্যা ও পূর্ণিমায় খোলস পাল্টিয়ে বৃদ্ধি লাভ করে। এ সময়ে এদের দেহ খুবই দুর্বল ও নরম থাকে। সেজন্য উপযুক্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করলে সবল কাঁকড়াগুলো দূর্বল গুলোকে খেয়ে ফেলে। প্রধানত দু'টি কারণে কাঁকড়ার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন
> খোলস পাল্টানোর পর আশ্রয়।
> অতিরৌদ হতে রক্ষা করা।
কাঁকড়ার আশ্রয়স্থল বিভিন্নভাবে করা যায়। যথা-
বাঁশের কঞ্চি বা বাবলা গাছের ডালপালা ঘেরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় পুঁতে
বা ফেলে রেখে।
> পুকুর তৈরির সময় তা দেশে ছোট ছোট মাটির ঢিলা বা পাহাড় তৈরি করে।
> বাঁশের তৈরি চোঙ্গা বা হি পাইস পুকুরের তলদেশে ব্যবহারের মাধ্যমে।
পানির গুণাগুণ ও ব্যবস্থাপনা
প্রাণীখালাই হতে মুক্ত রাখতে পানির
যে কোন জলজ
মাত্রায় বজায় রাখা পদক্ষেপ নিতে হবে
গুণাগুণ সঠিক
পানির গুণাগুণ কাঙ্খিত মাত্রায় রাখতে বিভিন্ন
জোয়ার ভাটা থেতো করতে হবে।
> অতিরিক্ত খাবারে
না হয়ে যায়।
প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণি। তর পানি ঢুকিয়ে ৫-৭ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন কমপক্ষে ভাগ পানি পরিবর্তন করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভাল উৎপাদনের জন্য
ঘেরে নিম্নে বর্ণিত পানির গুণাগুণ বজায় রাখা আবশ্যক (সারণি-৩)
পানির গুণাগুণ/মাত্রা | সর্বনিম্ন | সর্বোচ্চ |
---|---|---|
গভীরতা | ০.৮ মিটার | ১.২ মিটার |
তাপমাত্রা | ২২°সে. | ৩০°সে. |
লবণাক্ততা | ১০ পিপিটি | ২৫ পিপিটি |
দ্রবীভূত অক্সিজেন | ৪ পিপিএম | ৮ পিপিএম |
পিএইচ | ৭.৫ | ৮.৫ |
কাঁকড়া আহরণ ও বাজারজাতকরণ
ঘেরের সামগ্রিক পরিবেশ ভাল হলে ও প্রয়োজনীয় সুষম খাবার প্রয়োগ করতে পারলে ৩-৪ মাসের মধ্যে কাঁকড়া বাজারজাতযোগ্য হয়ে যায়। বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বনে কাঁকড়া আহরণ
করা যেতে পারে। যেমন
> ঝাঁকি জাল, বাঁশের ঝুড়ি ও চোঙ্গা ব্যবহারের মাধ্যমে আংশিকভাবে কাঁকড়া আহরণ করা যেতে পারে।
৪০
কাঁকড়া
জাহাড়া শেরপাঠিতে মাছ, বেঁধে কাঁকড়াকে প্রলুব্ধ নেট
নিয়মে ফেলতে হবে যেন চিমটা পা অবস্থায় বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। গোনায় পরিণত খোলস শক্ত না হলে এবং পরিবহন পা/চিমটা ভেঙ্গে গেলে কাঁকড়ার
লাভজনক কিছুটা ঝুঁকিও রয়েছে। সেজন্য চাষকালীন সময়ে বেশ কিছু
ছোট আকারের ঘেরে কাঁকড়া চাষ করা যাবে না, এতে স্বাভাবিক ব্যাহত
কাঁকড়া থেকে থেকে বের হয়ে যেতে না পারে এ ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। সেজন্য ঘেরের চতুর্দিকে নেট বা বাঁশের বানা তৈরি করে উঁচু করে বেড়া দিতে হবে। খোলস পাল্টানোর সময় উপযুক্ত আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ও পরিমাণমত উপযুক্ত খাবার প্রয়োগ করতে হবে।
পানি পরিবর্তনের মাধ্যমে ঘেরের পরিবেশ ঠিক রেখে কাঁকড়ার যথার্থ বৃদ্ধি নিশ্চিত
> উপযুক্ত মৌসুমে কাঁকড়া মজুদ ও আহরণ করতে হবে নতুবা বাজার মূল্য কম হবে।
ফ্যাটেনিং করে বাজারজাত অধিকতর জনপ্রিয় ও লাভজনক। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যে সমস্ত অপরিপক্ক কাঁকড়া (স্ত্রী ১৭০ পুরুষ ৪০০ গ্রামের নীচে) বিদেশে বলে বাজারে বা ডিপোতেও বিক্রি হয় না, সেসব কাঁকড়া উপযুক্ত পরিবেশ ২-৪ সপ্তাহ লালন-পালন করে পরিপক্ক বা গোনাড পরিপুষ্ট করাকে ফ্যাটেনিং বলা হয়। স্বল্পকালীন সময়ে উপযুক্ত পরিচর্যায় কাঁকড়ার লক্ষণীয় দৈহিক বৃদ্ধি না হলেও এ সময়ের মধ্যে প্রতিপালিত কাঁকড়া বাজারজাতকরণের মত কিছু কিছু যোগ্যতা অর্জন করে থাকে। অপেক্ষাকৃত স্বয় মৃত্যুহার ও স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক প্রযুক্তি হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং কার্যক্রম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাঁকড়া ফ্যাটেনিং এর সুবিধাগুলো হলোঃ
আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা।
অধিক লাভজনক।
স্বল্প সময়ে বাজারজাত করা যায়। মৃত্যু হার অপেক্ষাকৃত কম।
> উপকূলীয় ছোট ছোট জলাশয়ে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করা যায়।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ফ্যাটেনিং পদ্ধতি
ঘেরের স্থান নির্বাচন ও প্রস্তুতকরণ
ঘেরের মাটি যেন দোঁ-আশ বা পলি দোঁ-আশ হয়।
ঘের শুকিয়ে ভালভাবে শক্ত করে পাড় মেরামত করতে হবে যেন পানি চুঁইয়ে না যায় ও
কাঁকড়া গর্ত করে পালিয়ে যেতে না পারে।। ঘের থেকে কাঁকড়া যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য পানির কিনারা ঘেঁষে ১.৫ উচ্চতা বিশিষ্ট বাঁশের বানা এবং গর্ত করে যেন বেরিয়ে যেতে পারে সেজন্য মাটির নিচে
০.৫ মিটার বানা পুঁতে দিতে হবে। ঘেরের আয়তন ১০ শতাংশ থেকে ০.৫ একরের মধ্যে হলে ব্যবস্থাপনা সুবিধা হয়।
> পানির ৫-১০ পিপিটি উত্তম বলে বিবেচিত।
প্রস্তুতকরণ
কাঁকড়ার থেকে চুন সার প্রয়োগের পূর্বে ৩-৪ বার জোয়ারের পানি ০.৫ মিটার উচ্চ গভীরতা পর্যন্ত ঢুকিয়ে
মাটির পিএইচ এর উপর ভিত্তি করে মেরে চুল দিতে হবে। এ -৫ হলে প্রতি ১২৫ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে। নিম্ন মাত্রায় পিএইচ এর বৃদ্ধির জন্য ৩৫কেজি/হেক্টর হিসেবে চুন প্রয়োগ করতে হবে। কাঁকড়া চাষের জন্য
জৈবসার প্রয়োগের ৩ দিন পর হেক্টর প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া এবং ১৫ কেজি টি.এস.পি. ৭.৫-৮.৫ পিএইচ উত্তম। সার প্রয়োগ করতে হবে।
অরণের অজৈব সার প্রযোগের ৩-৪ দিন পর ঘেরে কাঁকড়া মজুদ করতে হবে।
পানির গুণাগুণ ও ব্যবস্থাপনা
টেনিং এর ক্ষেত্রে পানির পিএইচ, মজুদ ঘনত্ব, কাঁকড়ার ওজন, সরবরাহকৃত খাদ্যের মা সময়মত পানি পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে তাই সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। -ফ্যাটেনিং এর জন্য অপরিপক স্ত্রী কাঁকড়া এবং পুরুষ কাঁকড়ার উপযুক্ত ওজন, মজুদ হার ও পুরুষ কাঁকড়ার অনুপাত নিম্নরূপ হবে।।
সারণি-৪: ফ্যাটেনিং এর ক্ষেত্রে কাঁকড়ার মজুদ হার ও স্ত্রী। পুরুষ কাঁকড়ার অনুপাত
মজুদ হার | স্ত্রী: পুরুষ কাঁকড়ার অনুপাত | মঞ্জুদকৃত কাঁকড়ার ওজন |
---|---|---|
১০,০০০-১২,৫০০/হেক্টর | ৯:১ | পুরুষ ৪০০-৫০০ গ্রাম, স্ত্রী ১৭০ গ্রাম |
সাধারণত হেক্টর প্রতি মজুদ ঘনত্ব ১০,০০০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। তবে ঘেরের পরিবেশ, খাবার প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার মানের ওপর নির্ভর করে এই হার ১২,৫০০/হেক্টর করা যেতে পারে।
>প্রাণিজ মাংসল খাবার ফ্যাটেনিং এর জন্য উপযুক্ত হলেও দ্রুত পচনশীল বলে পানির
তথাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ অবস্থা রোধের জন্য প্রতি অমাবস্যা ও
পূর্ণিমায় ৩০% হারে ঘেরের পানি পরিবর্তন করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অভি মাত্রায় ও ঘন ঘন পানি পরিবর্তনের কারণে পরিণত কাঁকড়া ডিম ছাড়াসহ খোলস পরিবর্তনের প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে উৎপাদনের লক্ষ্য ব্যাহত হবে।
কাঁকড়া মজুদের ১০ দিন পর হতে কাঁকড়ার গোনাড পরিপুষ্ট হয়েছে কিনা। প্রতি ২-৩ দিন পর পরীক্ষা করতে হবে।
খাদ্য প্রয়োগ
কাঁকড়ার দ্রুত পরিগঞ্জ বা বাজারজাতযোগ্য আকারের করতে হলে অবশ্যই জীবন্ত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ
খাবার সরবারাহ করতে হবে। সম্পূরক খাবারে কমপক্ষে ৩০-৪০% আমিষ থাকতে হবে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় যে, চাষের ন্যায় কাঁকড়ার ফ্যাটেনিং এর বেলায়ও সারণি ২-এ প্রদর্শিত হারে খাবার দেয়া হলে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, এসব জীব খাবার সরাসরি বা ২-৩ সপ্তাহ ফ্রিজে সংরক্ষণ করেও ব্যবহার করা যায়।
আহরণ ও বাজারজাতকরণ
স্ত্রী কাঁকড়া এবং পুরুষ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে গোনাড পরিপুষ্ট হয়েছে নিশ্চিত হলে এবং পুরুষ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে খোলস শক্ত হলে আহরণ শুরু করতে হবে।
> আহরণের জন্য ঘেরে জোয়ারের পানি ঢোকানোর সময় কাঁকড়া যখন স্রোতের বিপরীতে এসে পানির প্রবেশ পথে ভিড় জমাবে, তখন স্কুপনেট দিয়ে ধরতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার টোপ ব্যবহার করে কাঁকড়াকে প্রলুদ্ধ করে স্কুপ নেট ব বাঁশের ঝুড়ির সাহায্যে আহরণ করা যায়।
> সম্পূর্ণ আহরণের ক্ষেত্রে পুকুর সেছে ফেলতে হবে।
ঘেরে যথাসম্ভব একই সময়ে একই আকারের কাঁকড়া মজুদ করতে হবে। নতুন এক অ খেয়ে ফেলবে। তাছাড়া চিমটার সাহায্যে বড় কাঁকড়া ছোট কাঁকড়াকে আঘাত করার সম্ভাবনা থাকে, ফলে রোগাক্রান্ত হতে পারে।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।