ভূমিকা : চিংড়ি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী একটি পণ্য। চাষের মাধ্যমে সাধারণতঃ দু'ধরণের চিংড়ি উৎপাদন করা হয়। একটি বাগদা (Penaeus monodon) এবং অন্যটি গলদা (Macrobrachium rosenbergii) চিংড়ি বাগদা চিংড়ি লোনা পানিতে এবং গলদা চিংড়ি স্বাদু কিংবা অল্প লবণাক্ত পানিতে চাষ করা হয়। দেশে বিদ্যমান বিস্তৃত চাষযোগ্য বাৎসরিক ও মৌসুমি স্বাদুপানির জলাশয় এবং ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিবেচনায় দেশে বাণিজ্যিকভাবে গলদা চিংড়ি চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। গলদা চিংড়ির প্রজনন, পোনা উৎপাদন কৌশল এবং চাষ প্রযুক্তি মোটামুটি সহজলভ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে এ চিংড়ির চাহিদাও যথেষ্ট। গলদা চাষের প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে চাষ পুকুরে সময়মত মজুদের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন পোনার অপ্রাপ্যতা অন্যতম। গলদা চিংড়ির চাষের সময় তুলনামূলকভাবে বেশি (৬-৮ মাস)। সাধারণত মার্চের শেষ হতে এপ্রিল মাসে গলদার ব্রুড সহজ প্রাপ্য হয় এবং এরপর পোনা তৈরীতে প্রায় ৪০ দিন সময় লেগে যায়। এতে চাষীদের কাছে গলদার পোনা মে মাসের শেষ নাগাদ সহজ প্রাপ্য হয় এবং পোনা হতে বাজারজাত উপযোগী চিংড়ি তৈরীর জন্য ৪-৫ মাসের বেশী সময় পাওয়া যায় না। কারণ নভেম্বর মাস হতে পানির তাপমাত্রা ২০º সে. এর নীচে নেমে যায় এবং এই তাপমাত্রায় গলদার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে চাষী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি ফেব্রুয়ারী মাসে গলদার ব্রুড সহজ প্রাপ্য করা যায়, তাহলে মার্চের শেষ নাগাদ চাষীদের কাছে পোনা সহজ প্রাপ্য করা যাবে। এতে চাষী বাজারজাত উপযোগী গলদা চিংড়ি তৈরীর জন্য যথেষ্ট সময়ও পাবে। এ লক্ষ্যে, গলদার আগাম ব্রুড উন্নয়নের জন্য ইনস্টিটিউটের পাইকগাছাস্থ লোনাপানি কেন্দ্র ও মাঠ পর্যায়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। দেখা গেছে, গ্রীন হাউজ পদ্ধতিতে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিপক্ক ডিমওয়ালা গলদা চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি : যে এলাকায় পুকুরের পানি প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন করা যায়, সে এলাকায় গ্রীন হাউজ পদ্ধতিতে আগাম পরিপক্ক গলদা চিংড়ি উৎপাদনের পুকুর নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয় । তাছাড়া, গ্রীন হাউজ পুকুরের জন্য এমন স্থান নির্বাচন করা আবশ্যক, যেখানে সার্বক্ষণিক সূর্যের আলো পাওয়া সম্ভব। সাধারণতঃ পুকুরের আকৃতি আয়তাকার এবং আয়তন ১৮০-২০০ বর্গমিটার হলে গ্রীন হাউজ তৈরী এবং এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। গ্রীন হাউজ তৈরি শীত মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর হতে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পুকুরের পানির তাপমাত্রা গলদা চিংড়ির ডিম্বাশয় পরিপক্কতার সহায়ক মাত্রায় (২৮-৩২° সে.) রাখার জন্য পুকুরের উপরে গ্রীন হাউজ তৈরী করা হয়। এ ধরণের হাউজ তৈরীর জন্য প্রথমে বাঁশের চাটাই দিয়ে দোচালাকৃতি ফ্রেম তৈরী করা হয়। এই ফ্রেমের উপরে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেয়া হয় যাতে কোথাও কোন ফাঁক না থাকে এবং প্রয়োজনে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য দু'পাশে কিয়দাংশ খুলে দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। দোচালার ফ্রেম এমনভাবে স্থাপন করতে হবে, যাতে দুই চালের মাঝ বরাবর পুকুরের পানি হতে চালার দূরত্ব ১৮০-২০০ সেমি থাকে। এতে গ্রীন হাউজের ভিতরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। পলিথিনের পুরুত্ব ০.৪-০.৫ মি.মি. হলে নির্দিষ্ট মাত্রায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হয়। অধিক পুরু পলিথিন ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রার অভি বৃদ্ধিতে চিংড়ির পীড়ন হতে পারে। পলিথিন যাতে বাতাসে উড়তে না পারে সেজন্য একটি বাঁশের চাটার তৈরী ফ্রেম পলিথিনের উপরে স্থাপন করা যেতে পারে। পুকুর প্রস্তুতি পুকুরের তলা হতে ৬-৮ সেমি. এর বেশী কাদা তুলে ফেলে, প্রতি ১০০ বর্গমিটারে ২৫০ গ্রাম হারে পাথুরে চুন ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর পুকুরে ১.০-১.৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত পানি সরবরাহ করে ২৫ পিপিএম হারে ডলো চুন প্রয়োগ করতে হবে। পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য অপর্যাপ্ত হলে ২.০-২.৫ পিপিএম হারে ইউরিয়া এবং ২.৫-৩.০ পিপিএম হারে টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। চিংড়ির আশ্রয়ের জন্য পুকুরে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ২/৩ স্থানে ঝোঁপ তৈরী করা যেতে পারে, যা চিংড়ির খোলস পাল্টানোর সময় আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
চিংড়ি মজুদ : নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহে যখন সাধারণতঃ পুকুরের পানির তাপমাত্রা কমতে শুরু করে তখনই গ্রীন হাউজযুক্ত পুকুরে চিংড়ি মজুদ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ২০টি হারে বাছাইকৃত সুস্থ সবল স্ত্রী ও পুরুষ চিংড়ি ৫:১ অনুপাতে পুকুরে মজুদ করতে হবে। প্রতিটি স্ত্রী চিংড়ির ওজন ৬০-৮০ গ্রাম এবং পুরুষ চিংড়ির ওজন ১০০-১২০ গ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্ত্রী চিংড়ির ওজন যত বেশী হবে তত ডিমের পরিমাণ ও বাজার মূল্য বেশী হবে। মজুদকৃত পুরুষ চিংড়ির দ্বিতীয় চলন পদ যাতে নীল ও লম্বা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, এ ধরণের পুরুষ চিংড়ি প্রজনন প্রক্রিয়ায় অধিকতর সক্রিয় থাকে।
খাদ্য সরবরাহ : গলদা চিংড়ির ব্রুড তৈরীর জন্য ৪৫% আমিষ সমৃদ্ধ দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন। প্রতিদিন সকালে ও বিকালে মোট মজুদকৃত চিংড়ির ওজনের ৩-৪% হারে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। প্রতি কেজি চিংড়ির খাদ্যে ১-২ মিলি. হারে কড লিভার তৈল মিশিয়ে প্রয়োগ করলে ডিম পরিপক্কতা ত্বরান্বিত হতে সহায়ক হয়।
পানি ব্যবস্থাপনা : গ্রীন হাউজ পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ির আগাম ব্রুড উন্নয়নে পুকুরের পানি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানির তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য পুকুরে সার্বক্ষণিক একটি থার্মোমিটার ঝুলিয়ে রাখতে হবে এবং সকাল-দুপুর-বিকাল পুকুরের পানির তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। কোন কারণে যদি পানির তাপমাত্রা ৩২° সে. এর বেশী হয়ে যায় তাহলে পলিথিনের কিয়দাংশ খুলে দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে হবে। পি-এইচসহ পানির অন্যান্য গুণাগুণ যথাযথ মাত্রায় রাখার জন্য প্রতি পনের দিন অন্তর পানিতে ১০-১৫ পিপিএম হারে ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। পানির স্বচ্ছতা যদি ৩০ সেমি. এর চেয়ে কমে যায় তাহলে পুকুরের ১০-১৫% পানি পরিস্কার স্বাদু বা অল্প লোনা (২-৩ পিপিটি) পানি দিয়ে পরিবর্তন করতে হবে। অধিক লবণাক্ত পানি চিংড়ির পরিপক্কতায় বিলম্ব ঘটাতে পারে। এ ছাড়া প্রতি পনের দিন অন্তর পানিতে চুন প্রয়োগের পূর্বে কিছু পানি পরিবর্তন করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। তবে কোনভাবেই একবারে ১০% এর বেশী পানি পরিবর্তন করা উচিত হবে না। এতে তাপমাত্রার অধিক তারতম্য হয়ে চিংড়ির পীড়ন হতে পারে। চিংড়ির গায়ে কালো দাগ বা শ্যাওলা পরিলক্ষিত হলে, প্রতি ১০০ বর্গমিটারে ৩৫০-৪০০ গ্রাম হারে জিওলাইট প্রয়োগ করা যেতে পারে। ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে স্বাভাবিক যে কোন পুকুরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে শেষ সপ্তাহে কিংবা মার্চের প্রথম সপ্তাহে গ্রীন হাউজ পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমান হয়ে যায়। এমতাবস্থায়, গ্রীন হাউজের পলিথিনের ঢাকনা খুলে ফেলতে হবে।
চিংড়ির পরিপক্কতা পরীক্ষা : মজুদের পনের দিন পর থেকে প্রতি সাত দিন অন্তর ঝাঁকি জাল টেনে চিংড়ির পরিপক্কতা পরীক্ষা করতে হবে। চিংড়ির পেটে কমলা রংয়ের ডিম পরিলক্ষিত হলেই সে চিংড়ি ধরে পোনা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারিতে স্থানান্তর করা যেতে পারে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, সম্পূর্ণ শীত মৌসুমে পুকুরে গ্রীন হাউজ পদ্ধতিতে শীততাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গলদা চিংড়ির প্রজননক্ষম ব্রুড উৎপাদন করা সম্ভব।
মাঠ পর্যায়ে গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত খোলা পুকুরে কোন চিংড়ির পেটে ডিম আসেনি কিংবা ডিম্বাশয় পরিপক্ক হয়নি। অন্যদিকে, গ্রীন হাউজ পুকুরে জানুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে চিংড়ির ডিম্বাশয় পরিপক্ক হয়ে মাথা লাল হতে শুরু করে এবং ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে চিংড়ির পেটে ডিম আসতে শুরু করে।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।