ভূমিকা :মাছে-ভাতে বাঙ্গালী একটি প্রাচীনতম প্রবাদ। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় (অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, ধান ক্ষেতে কীটনাশকের যথেচ্ছা ব্যবহার, নির্বিচারে মাছ আহরণে, প্রজননকালে অনূকূল তাপমাত্রার ব্যতয়, শিল্পায়নের ফলে পানি দূষণ ইত্যাদি) জলজ পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় বাংলাদেশের নদী-নালা, খাল-বিলে মাছের প্রাচুর্যতা বাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। দিন দিন প্রাকৃতিক উৎস থেকে অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের বৃদ্ধি হার বিদেশী মাছের তুলনায় কম হওয়ায় অধিক মৃণাফার আশায় চাষীরা বিদেশী মাছ চাষে বেশী উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সুস্বাদু দেশী মাছগুলো বিপন্নতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিপন্নতার হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃত্রিম প্রজননের পাশাপাশি প্রয়োজন দেশীয় সহজলভ্য উপাদানে তৈরী মৎস্য খাদ্য প্রয়োগ করে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ বৃদ্ধি করা। আশার কথা ইদানিং বিপন্ন প্রজাতির মাছ চাষে চাষী ও উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে পাবদা , গুলশা, মেনি, কৈ,শিং,মাগুর, দেশীপুটি, মহাশোল, ভাগনা, চিতল
ও কুচিয়া মাছের কৃত্রিম ও নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে বিপন্নতার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ফলি একটি সুস্বাদ দেশীয় প্রজাতির মাছ। ফলি মাছ লম্বায় ৬০ সেমি. পর্যন্ত হতে পারে। প্রকৃতিতে ফলি মাছ আজ বিপন্নপ্রায় । অতি আহরণ, রাক্ষুসে স্বভাব, আবাসস্থল বিনষ্ট এবং ডিম ধারণ ক্ষমতা কম বিধায় ফলি মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করে বিধায় ফলি মাছ চাষযোগ্য। ফলি মাছ রক্ষার প্রধানতম উপায় হলো এ মাছের ব্রুড ব্যবস্থাপনা ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করা। পাশাপাশি এর চাষ কৌশল উদ্ভাবন করে চাষী পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া।
ফলি মাছের কৃত্রিম প্রজনন :
কৃত্রিম প্রজননের জন্য ডিমের পরিপক্কতার সময় জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। গোনাড হিস্টোলজী ও জিএসআই পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় ফলি মাছ মে-জুন মাসে প্রজনন করে থাকে। প্রকৃতিতে এরা জলজ আগাছা অর্থাৎ ঘাস ও লতাপাতার উপর ডিম দিয়ে থাকে। ফলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে একসাথে অধিক পোনা বা ডিম সংগ্রহ করা কঠিন। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে নানা প্রতিকূলতায় পোনার বেঁচে থাকার হার কম। স্বভোজি বা ক্যানাবলিজম বৈশিষ্ট্য থাকার ফলে নির্দিষ্ট সময়ান্তে নিজেরাই নিজেদের পোনা ভক্ষণ করে থাকে। পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করে পোনা প্রতিপালন করলে ক্যানাবলিজম বৈশিষ্ট্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
প্রজননক্ষম মাছ সনাক্তকরণ :
স্ত্রী এবং পুরুষ মাছকে সনাক্ত করার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পৃষ্টপাখনার সাথে সংযুক্ত কাঁটা। প্রজননক্ষম পুরুষ এবং স্ত্রী মাছ সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নের ছকে উল্লেখ করা হলো :
বৈশিষ্ট্য: | পুরুষ মাছ | স্ত্রী মাছ |
---|---|---|
আকার | অপেক্ষাকৃত বড় | তুলনামূলকভাবে ছোট |
জননাঙ্গ | সরু ও লালচে বর্ণের জননাঙ্গ, শোণী পাখনা (Pelvic Fin) অপেক্ষা বড় | বৃহৎ ও সাদাটে জননাঙ্গ, শ্রোণী পাখনা (Pelvic Fin)অপেক্ষা ছোট |
পৃষ্টপাখনার সংযুক্ত কাঁটা | পুরুষ মাছের ক্ষেত্রে এই কাঁটা তুলনামূলকভাবে বড় হয়ে থাকে | স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে এই কাঁটা ছোট হয়ে থাকে |
পোনা উৎপাদন কৌশল:
কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রজনন মৌসুমের শুরুতে স্ত্রী এবং পুরুষ মাছকে ভিন্ন ভিন্ন পুকুরে মজুদ করতে হবে। দেহ ওজনের ৫-৩% হারে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। আবহাওয়ার তারতম্য ভেদে এবং সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের ওপর ফলি মাছের প্রজনন অনেকাংশে নির্ভর করে। সাধারণত: মে থেকে জুন মাস পর্যন্ত এই মাছ প্রজনন করে থাকলেও জুন মাসের মাঝামাঝি হলো সর্বোচ্চ প্রজননকাল। প্রজনন মৌসুমে মাছ পরীক্ষা করে প্রজননক্ষম মাছ নির্বাচন করতে হবে। প্রথমত জননাঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে স্ত্রী এবং পুরুষ মাছকে সনাক্ত করতে হবে। পাশাপাশি প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী মাছের পেট পরিপক্ক ডিমের জন্য ফোলা থাকে ও নরম থাকে। পেটের দুইপাশ অনেকটা সুপারির আকার ধারণ করে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য পুরুষ এবং স্ত্রী ফলি মাছের পৃষ্টপাখনার নীচে পিজি দ্রবণের ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়।
নিম্নের ছকে পিজি দ্রবণ প্রয়োগের পরিমাণ, Ovulation Time, নিষিক্ত ডিমের হার, প্রস্ফুটনের সময় প্রস্ফুটনের হার এবং ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার সময় উল্লেখ করা হলো :
লিঙ্গ | পুরুষ | স্ত্রী |
---|---|---|
পিজি দ্রবণের | পরিমাণ/প্রতি কেজি মাছ | ২.৫ মি.গ্রাম | ৪ মি.গ্রাম |
Ovulation Time | ১৮-২০ ঘণ্টা | ১৮-২০ ঘণ্টা |
নিষিক্ত ডিমের হার (Fertilization Rate) | ৫৫-৭০% | ৫৫-৭০% |
পরিস্ফুটনের সময় (Hatching (Time) | ৩-৪ দিন | ৩-৪ দিন |
পরিস্ফুটনের হার (Hatching Rate) | ৩৫-৫৬% | ৩৫-৫৬% |
ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার সময় (Yolk sac absorption period) | ৪-৫ দিন | ৪-৫ দিন |
পিজি দ্রবণের ইনজেকশন প্রয়োগের ২৪ ঘন্টা পর পুরুষ মাছকে কেটে গোনাড সংগ্রহ করে টুকরা টুকরা কেটে ০.৮% লবণ দ্রবণে মিশিয়ে শুক্রাণুর দ্রবণ তৈরী কাজ। অতপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে স্ত্রী মাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করে শুক্রাণুক্তি করা হয়। তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে নিষিক্ত ডিম থেকে ৩-৪ দিন পর রেণু পোনা বের হয়। পরবর্তীতে ২-৩ দিন পর Incubation জার থেকে রেণু পোনাগুলো সরিয়ে ট্রেতে নেওয়া হয় এবং সেখানে ১৫ দিন লালন করা হয়। ডিম প্রস্ফুটনের ৪-৫ দিন পর ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার পর রেণু পোনাকে প্রতিদিন চারবার (৬ ঘন্টা পর পর) সেদ্ধ ডিমের কুসুম ৪-৫ দিন পর্যন্ত খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করতে হবে
হাপায় ফলি মাছের নার্সিং ব্যবস্থাপনা : পুকুরে দৈর্ঘ্যে ৩ ফুট এবং প্রস্থে ৩ ফুট আকারের ফিল্টার নেটের হাপা ৪টি বাঁশের খুটিতে স্থাপন করে বৈধে দিতে হবে। অতঃপর উৎপাদিত ফলি মাছের রেণু পোনাকে পুকুরে স্থাপিত হাপায় প্রতিপালন করতে হবে। প্রতি ঘনমিটারে হাপা প্রতি ৫-৭ দিন বয়সী ৩০০-৫০০টি রেণু পোনা মজুদ করা যায়। খাদ্য হিসেবে ক্ষুদ্র প্রাণিকণা, জীবিত যে কোন মাছের রেণু সরবরাহ করতে হবে। খাবার নিশ্চিতকরণের জন্য যে কোন মাছের রেণু পোনা অধিক ঘনত্বে মজুদ করতে হবে। পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করা হলে পোনার বেঁচে থাকার হার ৯০%। সপ্তাহে ১ দিন হাপা পরিস্কার করে দিতে হবে। খাদ্য সরবরাহ ঠিক থাকলে ১৫ দিনে মাছ ১-১.২৫ ইঞ্চিতে পরিণত হয় এবং এই সময় মাছের গায়ে জেব্রার মতো দাগ ফুটে উঠে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পোনার শরীর থেকে এই দাগ বিলুপ্ত হয়ে যায়। রেণু পোনার আকার ২-৩ ইঞ্চি না হওয়া পর্যন্ত লালন করতে হবে এবং পরবর্তীতে নার্সারী পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।পাদন করে অধিকতর উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রয় করা সম্ভব ।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।