বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় খাল-বিল ও পুকুরে উৎপাদিত দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছ এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এসব মাছের মধ্যে রয়েছে পাবদা, গুলশা, শিং, ট্যাংরা ইত্যাদি। রপ্তানি হয় ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপান, কানাডা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ভারত, নেপাল প্রভৃতি দেশে। স্থানীয় মৎস্য বিভাগ বলছে, ভরা মৌসুমে বগুড়া অঞ্চলের পুকুর ও খালে-বিলে প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার মেট্রিক টন দেশি মাছ উৎপাদিত হয়। পোনা ছাড়ার পর চার মাসের মধ্যে তা রপ্তানির উপযোগী হয়ে ওঠে। মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন বা ৩০ শতাংশের কিছু বেশি রপ্তানি হয়। সব মিলিয়ে বগুড়া অঞ্চল থেকে বছরে মাছ রপ্তানি হয় ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকার। প্রায় এক দশক ধরে বগুড়ার কাহালু, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘি ও শিবগঞ্জ এবং জয়পুরহাটের কালাই, ক্ষেতলাল, আক্কেলপুর ও পাঁচবিবি উপজেলায় সহস্রাধিক মৎস্য খামারি এবং চাষি পুকুর ও খালে-বিলে বাণিজ্যিকভাবে দেশি মাছের চাষ করছেন। পাশাপাশি মাছের পোনা উৎপাদনে দুই জেলায় গড়ে উঠেছে শতাধিক হ্যাচারি। চাষটা শুরু হয়েছিল মাগুর মাছ দিয়ে। লাভজনক হওয়ায় পরবর্তী সময়ে চাষের তালিকায় যোগ হয় শিং, ট্যাংরা, কই, পাবদা, গুলশাসহ নানা প্রজাতির মাছ। এসব মাছের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রপ্তানিকারকেরা খাল-বিল-পুকুর ও আড়ত থেকে কিনে নেন। বাকি মাছ স্থানীয় বাজারগুলোর পাশাপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। শিক্ষিত অনেক তরুণ দেশি মাছ চাষে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তেমনই একজন হাতিয়র গ্রামের খামারি কাজী জাকির হোসেন। তিনি জানান, ১২০ বিঘা আয়তনের পুকুরে মাছ চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত খরচ করেছেন ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৪ হাজার মণ দেশি মাছ উৎপাদনের আশা করছেন তিনি।জাকির হোসেন আরও জানান, আট বছর আগে সামান্য পুঁজি নিয়ে ৮০ শতকের পুকুরে দেশি মাগুর চাষ শুরু করেন। পরে অন্যান্য মাছ চাষেও ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। জানতে চাইলে খুলনার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কেবিসি ইন্টারন্যাশনালের মালিক গোপাল বিশ্বাস বলেন, ‘তিন বছর ধরে বগুড়া ও জয়পুরহাট থেকে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ পাবদা মাছ কিনে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে রপ্তানি করছি।’ সম্প্রতি কাহালু উপজেলার স্টেশনবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, কার্টনে বরফ মুড়িয়ে পাবদা মাছ প্যাকেট করা হচ্ছে রপ্তানির জন্য। প্রতিটি কার্টনে ২১ কেজি করে পাবদা মাছ প্যাকেট করা হয়। মৎস্য খামারি ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানির জন্য ২০ থেকে ২৫টিতে এক কেজি হয় এমন আকারের পাবদার চাহিদা বেশি। এখন প্রতি মণ পাবদা ১০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। করোনার আগে বিক্রি করতেন ১৬ হাজার টাকায়। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি শফিকুল ইসলাম কাহালু উপজেলার বিবিরপুকুরে হ্যাচারি গড়ে রেণু থেকে পাবদা, ট্যাংরা, শিং, কই, মাগুর ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদন করেন। তিনি বলেন, ‘চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন হরেক প্রজাতির দেশি মাছের পোনা উৎপাদন করছি। করোনার মধ্যেও ৩ হাজার কেজি পাবদার পোনা উৎপাদন করেছি আমরা।’ মাছের পাইকার বিকাশ রায় প্রথম আলোকে জানান, তিনি চট্টগ্রামের রপ্তানিকারকদের কাছে এ গ্রেডের অর্থাৎ বড় আকারের পাবদা ৩৩০-৩৪০ টাকা ও গুলশা ৫২৫-৫৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকার আড়তদারসহ দারাজ বিডি ডটকম, চাল ডাল ডটকম, স্বপ্ন, আন্দাজ, বিডি ফুডস, মাসুদ ফুডস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানেও মাছ সরবরাহ করেন। চট্টগ্রামের রপ্তানিকারক মিলন ভট্টাচার্য জানান, তিনি বগুড়া ও জয়পুরহাট থেকে পাবদা, গুলশা ও শিং মাছ সংগ্রহ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) পাঠান। জানতে চাইলে বগুড়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার আনোয়ারুল কবীর আহম্মেদ বলেন, এই জেলায় বছরে মাছের চাহিদা ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। ৩৩ হাজার মৎস্যচাষি ও খামারি বছরে উৎপাদন করেন ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। তিনি আরও জানান, খামারি ও মৎস্যচাষিদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশই দেশি জাতের মাছ চাষ করেন।
প্রচলিত প্রবাদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। কিন্তু এখন কি আর এ কথাটি জোর দিয়ে বলা যায়? এর কারণ অনেক। তবে আমাদের সম্মিলিত হেয়ালিপনা আমাদের এ পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে। কোথায় হারিয়ে গেছে আমাদের শোল, গজার, ভেটকি, পাবদা, টাকি, বউমাছ, তাপসি, গুলশা, কাচকি, খৈশা, কৈ, চিতল, বোয়াল, টেংরা, আইড়, বাইন, পুঁটি, শিং, পলি, মাগুর এসব। আমাদের এসব দেশি মাছ সংরক্ষণ জরুরি। তাছাড়া এ দেশের নদী-নালা, খাল বিল হাওরে ও সমুদ্রে যে পরিমাণ মাছ উৎপন্ন হয় তার মধ্যে অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায় পরিবহন সংরক্ষণের অভাবে। মাছ ধরার পর শতকরা ৩০ ভাগ মাছ ক্রেতার হাতে পৌঁছার আগেই পচে নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
তাহলে দেশি মাছ সংরক্ষণে আমাদের কী কী করণীয়?
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের বেশ কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। সেগুলো হলো মৎস্য আইন মেনে চলা, কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা, জেলে পরিবারের আর্থসামাজিক নিশ্চয়তা, দেশব্যাপী মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, পুরনো জলাশয়গুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন, ছোট মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ, প্লাবনভূমির বেহাত হওয়া রোধ করা, দেশি পোনা উৎপাদন ও প্লাবন ভূমিতে মজুদকরণ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছোট মাছ চাষ ও সংরক্ষণ এবং জাটকা মাছ সংরক্ষণ।
দেশি মাছ সংরক্ষণে করণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়গুলো কী?
এ বিষয়গুলোর মধ্যে সবার আগে আমাদের ভাবতে হবে প্রাকৃতিক জলাশয়, প্লাবনভূমি, জাটকা মাছ সংরক্ষণ এবং মৎস্য পরিবেশবান্ধব নীতি ও অবকাঠামো সম্পর্কে। কারণ বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মধ্যে ১২টি চরম বিপন্ন এবং ১৪টি সংকটাপন্ন। যদিও আমাদের আছে চিংড়িসহ ২৯৬টি মিঠাপানির মাছ এবং ৫১১টি সামুদ্রিক মাছ। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে মাছের যে প্রাকৃতিক জলাশয়, মুক্ত জলাশয় এবং প্লাবনভূমি রয়েছে তা আমাদের অযাচিত ও অনৈতিক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তারকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। মাছের জাটকা সংরক্ষণে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মৎস্য অধিদপ্তর বেশ প্রচার প্রচারণা করছে কিন্তু সে বিষয়টি এখনও সাড়া জাগানো সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়নি। জাটকা মাছ অবশ্যই সংরক্ষণ ও প্লাবনভূমি, মুক্ত জলাশয়ে তা অবাধে বিচরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা পোল্ডার এবং গ্রাম পর্যায়ে অপরিকল্পিত কাঁচা রাস্তা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে মাছের চলাচল, প্রজনন ব্যাহত না হয়। আর প্রয়োজন এ বিষয়ে আমাদের সামাজিক আন্দোলন। সেক্ষেত্রে আমরা মাছ ধরার ক্ষেত্রে কখনোই বিষ, রোটেননসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করব না। বরং দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক চেহারাটাই পাল্টে দেয়া সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন মৎস্যবান্ধব পরিবেশনীতি ও অবকাঠামোর সফল বাস্তবায়ন।
দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষ করলে আমাদের কী লাভ?
কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আঁধার। দেশি এ মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন। তাছাড়া দেশি মাছের আছে অন্ধত্ব, রক্তশূন্যতা, গলগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ছোট ছোট মাছ খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। দেশি মাছের এসব পুষ্টিগুণ আমিষের নিরাপত্তা গড়ে তুলতে অতুলনীয়। এ কারণেই দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষ করলে আমাদের অনেক লাভ।
মাছ চাষের মাধ্যমে আমরা কিভাবে দেশি মাছ সংরক্ষণ করতে পারি?
দেশি মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন আমরা করতে পারি। সেগুলো হলো ধান ক্ষেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধানক্ষেতে মিনি পুকুর তৈরি; মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সাথে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় প্লাবনভূমি এবং পুকুরে দেশি মাছের চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
দেশি মাছ চাষে সামাজিক আন্দোলন এ বিষয়টি কিভাবে বিশ্লেষণ করা যায়
বর্তমানে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষেত্র, চলাচল অনেকখানি হুমকির মুখে। আমরা না জেনে, না বুঝে জাটকা নিধন করি। তাছাড়া জমিতে অতি মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ দেয়া, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত না থাকার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না। কিন্তু এ বিষয়গুলো যদি আমরা সবাই জানি এবং সচেতন হই তাহলে আমরা কিন্তু সারাবছর দেশি মাছের স্বাদ ও পুষ্টি পেতাম। বর্তমান এ অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দরকার সবার আন্তরিকতা। আর এটিই হলো সামাজিক আন্দোলন।
মাছ বিক্রির সময় পরিবহনজনিত কারণে যে মাছ নষ্ট হয়, সে কারণেও তো আমাদের দেশি মাছ বেশি ধরা হয়। কিন্তু যদি তা ভালোভাবে সংরক্ষণ করে পরিবহন করা যেত তাহলে তো দেশি মাছ আমরা আরও বেশি পেতাম। মাছ পরিবহনে লাগসই প্রযুক্তি হলো সস্তা অথচ কার্যকরী বরফ বাক্স। এতে মাছ পরিবহন কৌশলটিতে বহুল ব্যবহৃত বাঁশের ঝুড়ির উন্নয়ন ঘটিয়ে তাপ চলাচল প্রতিরোধী বরফ বাক্সে পরিণত করা হয়েছে। পরিবর্তিত ঝুড়িতে মাছ ঝুড়ির সংস্পর্শে আসে না। তাই বাঁশের চটির ফাঁকফোকর থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। এমনকি পলিথিন দিয়ে আগাগোড়া মোড়া থাকে বলে বার বার পরিষ্কার করে একই ঝুড়ি ব্যবহারেও সমস্যা হয় না। ২৫ থেকে ৩০ কেজি মাছ ধরে এমন একটি বাঁশের ঝুড়ির ভেতরের দিকটা হোগলা পাটি দিয়ে মুড়ে দিতে হয়।
হোগলার ওপর দুই স্তর প্লাস্টিকের শিট দিয়ে সেলাই করে দিতে হয়। শিটের কিছু অংশ বাড়তি থাকবে। সেলাই করা প্লাস্টিকের শিটের ওপর আর একটি পাতলা স্বচ্ছ পলিথিন শিট বিছিয়ে বরফ দেয়া মাছ পরিবহন করতে হবে। প্রথমে পলিথিন শিটের ওপর এক স্তর বরফ রেখে মাছ সাজিয়ে দিতে হয়। এরপর ভাঁজে ভাঁজে বরফ ও মাছের স্তর সাজিয়ে ওপরে জাম বরফ দিয়ে বাড়তি চট, হোগলা ও পলিথিন শিট একসাথে মুড়ে ঝুড়ির ওপরে বেঁধে নিতে হয়। ঝুড়ির মুখ সব সময় বেঁধে রেখে মাছ পরিবহন করতে হয়। এভাবে বরফ দেয়া মাছ ২৪ ঘণ্টা পুনরায় বরফ না দিয়ে গুণাগুণ সঠিক রেখে সংরক্ষণ করা যায়। ২৪ ঘণ্টা পর পর মাছের ওপর সামান্য জাম বরফ দিয়ে প্রায় ৫-৬ দিন পর্যন্ত খুব ভালোভাবে মাছকে সংরক্ষণ করা যায়। হোগলাপাতা, ছেঁড়াজাল বা নাইলন কাপড় চমৎকার তাপ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। আর এ কৌশলটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রফেসর ড. নওশাদ আলম এ কার্যকরী বরফ বাক্স উদ্ভাবন করেছেন। বরফ বাক্সটি মাঠপর্যায়ে মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াজাতকারী ও মৎস্য পরিবহনকারীদের দ্বারা সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারপরও যদি কোনো সমস্যা ও জানার থাকলে উপজেলা মৎস্য অফিস এবং ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ ও দেশি পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
মাছ সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়, এ ক্ষেত্রে দেশি মাছ সংরক্ষণের কী কোনো ব্যবস্থাই নেই?
বেশ কিছু দিন আগেও আমাদের কাছে এ সমস্যার কার্যকরী কোনো সমাধান ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ও মাছচাষিদের উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রফেসর ড. নওশাদ আলম সহজ ও কম খরচে মাছ পরিবহনের জন্য একটি কার্যকরী বরফ বাক্স উদ্ভাবন করেছেন। বরফ বাক্সটি মাঠ পর্যায়ে মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াজাতকারী ও মৎস্য পরিবহনকারীদের দ্বারা সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আমাদের সে মাছ সংরক্ষণের কার্যকর কৌশল তাহলে কেমন হবে?
সস্তা অথচ কার্যকরী বরফ বাক্সে মাছ পরিবহন কৌশলটিতে বহুল ব্যবহৃত বাঁশের ঝুড়ির উন্নয়ন ঘটিয়ে তাপ চলাচল প্রতিরোধী বরফ বাক্সে পরিণত করা হয়েছে। পরিবর্তিত ঝুড়িতে মাছ ঝুড়ির সংস্পর্শে আসে না। তাই বাঁশের চটির ফাঁকফোকর থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। এমনকি পলিথিন দিয়ে আগাগোড়া মোড়া থাকে বলে বার বার পরিষ্কার করে একই ঝুড়ি ব্যবহারেও সমস্যা হয় না। ২৫ থেকে ৩০ কেজি মাছ ধরে এমন একটি বাঁশের ঝুড়ির ভেতরের দিকটা হোগলা পাটি দিয়ে মুড়ে দিতে হয়। হোগলার ওপর দুই স্তর প্লাস্টিকের শিট দিয়ে সেলাই করে দিতে হয়। শিটের কিছু অংশ বাড়তি থাকবে। সেলাই করা প্লাস্টিকের শিটের ওপর আর একটি পাতলা স্বচ্ছ পলিথিন শিট বিছিয়ে বরফ দেয়া মাছ পরিবহন করতে হবে। প্রথমে পলিথিন শিটের ওপর একস্তর বরফ রেখে মাছ সাজিয়ে দিতে হয়। এরপর ভাঁজে ভাঁজে বরফ ও মাছের স্তর সাজিয়ে ওপরে জাম বরফ দিয়ে বাড়তি চট, হোগলা ও পলিথিন শিট একসাথে মুড়ে ঝুড়ির ওপরে বেঁধে নিতে হয়। ঝুড়ির মুখ সব সময় বেঁধে রেখে মাছ পরিবহন করতে হয়। এভাবে বরফ দেয়া মাছ ২৪ ঘণ্টা পুনরায় বরফ না দিয়ে গুণাগুণ সঠিক রেখে সংরক্ষণ করা যায়। ২৪ ঘণ্টা পর পর মাছের ওপর সামান্য জাম বরফ দিয়ে প্রায় ৫-৬ দিন পর্যন্ত খুব ভালোভাবে মাছকে সংরক্ষণ করা যায়। হোগলাপাতা, ছেঁড়াজাল, বা নাইলন কাপড় চমৎকার তাপ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করা ছাড়াও আর কিভাবে আমরা দেশি মাছ সংরক্ষণ করতে পারি?
মাছ শুঁটকি করেও সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধ করতে অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য উৎপাদিত বেশির ভাগ শুঁটকিতে ব্যবসায়ীরা ডিডিটি, নগসসহ নানাবিদ দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অনেক দিন ধরে এসব শুঁটকি খেলে মানুষের কিডনি ও লিভার পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শুঁটকিতে কীটনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য আইনে দ-নীয় অপরাধ। পোকামাকড়ের আক্রমণ ও ধুলোবালি প্রতিরোধ করে কীটনাশকমুক্ত শুঁটকি তৈরির জন্য ড. নওশাদ আলম স্বল্পমূল্যে সহজে পাওয়া যায় বস্তু দিয়ে তৈরি বক্স ও রিং টানেল উদ্ভাবন করেছেন, যা খুব কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এই যে স্বল্পমূল্যে সহজে পাওয়া যায় এমন বস্তু দিয়ে তৈরি বক্স ও রিং টানেল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে নিতে হবে
জালে ঢাকা বক্স টানেল তৈরিতে বাঁশের বা কাঠের খুঁটির ওপর ৩ ফুট উচ্চতায় চার ফুট চওড়া ও ২০ ফুট লম্বা একটি বাঁশের আয়তাকার মাচা তৈরি করে মাচার ওপর সামনের দিকে ক্রমাগত ঢালু হয়ে আসা একটি আয়তাকার টানেল বসিয়ে দিতে হয়। ঢালু করার জন্য টানেলটির পেছনের খাঁড়া পা দু’টির উচ্চতা ২.৫ ফুট এবং সামনের খাঁড়া পা দুটি ২ ফুট দূরে রাখতে হয়। এবার টানেলের ওপর থেকে সারি সারি মাছ ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য ছাদের এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে নির্দিষ্ট দূরত্বে পর পর সমান্তরাল করে কতগুলো বাঁশ বেঁধে দিতে হবে।
ছাদ ঢালু করার ফলে টানেলের ভেতরে ঝুলে থাকা প্রতিটি মাছ সমানহারে সূর্যের আলো পায়। ভেতরের মাছ ঝুলানোর পরিসর বেড়ে যাবে। তাছাড়া টানেলের উপরিস্তরের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বেশি সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে। টানেলে মাছ ঝুলিয়ে দেয়ার পর পুরো টানেলটি আগাগোড়া নিচ্ছিদ্রভাবে মশারি জাল দিয়ে ঢেকে দিয়ে রাতে বা ভোর হওয়ার আগে টানেলে মাছ ঝুলিয়ে দিতে হবে। অন্ধকারে মাছির দৃষ্টিশক্তি কমে যায় বলে মাছি চলাচল করে না। টানেলের ভেতর ঝুলানো থাকে বলে দিনের বেলা মাছ উল্টিয়ে এপিঠওপিঠ করে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় মাছের কাছে আসতে পারে না। এভাবে আমরা খুব সহজে মাছ সংরক্ষণ করতে পারি। এ ব্যাপারে আরও তথ্য বা পরামর্শের প্রয়োজন হলে আপনার কাছের উপজেলা বা অন্য কোনো মৎস্য অফিসের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আশা করি তারা আপনার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারবেন।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।