মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি। প্রকৃতির বিচিত্র বাহারি মাছ যখন স্বচ্ছ কাচের জলজবাগানে ঘুরে বেড়ায় তা দেখতে কার না ভালো লাগে! অ্যাকুরিয়াম হচ্ছে এমনি ধরনের চারদিকে কাচ দিয়ে ঘেরা জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পাত্র, যেখানে মাছ ও উদ্ভিদ রাখা সম্ভব। অ্যাকুরিয়াম কেবল শখ কিংবা শোভাবর্ধনকারী নয়, এর বাণিজ্যিক গুরুত্বও রয়েছে বেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে রাজধানীর কাঁটাবনে গড়ে উঠেছে অ্যাকুরিয়ামের জমজমাট ব্যবসা। পাশাপাশি নিউমার্কেট, গুলশান এবং বনানীতে বেশ কয়টি দোকান রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও এর যাবতীয় উপকরণ পাওয়া যায়। যদিও কোনো এক সময় অ্যাকুরিয়ামে মাছ পালন ছিল ব্যয়সাধ্য। এখন তা কিন্তু নয়। শৌখিনতা ও ক্রয়ক্ষমতার কারণে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ইচ্ছে করলে আপনিও এর অংশীদার হতে পারেন।
অ্যাকুরিয়াম তৈরি : অ্যাকুরিয়াম তৈরির জন্য প্রথমেই আকৃতি নির্বাচন করতে হয়। আয়তাকার, ত্রিকোণাকার, বোতলাকৃতি, ছয়কোণা যে কোনো ফ্রেমেই হোক; তাতে পানির চাপ সহ্য করতে পারবে এমন শক্ত ও স্বচ্ছ কাচ ব্যবহার করা উচিত। এজন্য কাচের পুরু হবে কমপক্ষে ৬০ মিলিমিটার এবং এর সংযোগস্থলে বিশেষ ধরনের আঠা লাগাতে হবে। তলার কাচটি (ধারক) অবশ্যই ভারি হওয়া দরকার, যাতে অ্যাকুরিয়ামের পুরো ওজন বহন করতে পারে। তবে আকার বড় হলে লোহার ধারক ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। ওপরের ঢাকনা হিসেবে কাঠ, প্লাস্টিক কিংবা অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করা যায়। এছাড়া ঢাকনা খোলা এবং বন্ধ করার ব্যবস্থা রাখা দরকার। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে অ্যাকুরিয়ামের প্রস্থ এবং উচ্চতা উভয়ই যেন দৈর্ঘ্যরে অর্ধেক হয়।
উপকরণ : অ্যাকুরিয়ামে মাছ পালনের জন্য যেসব উপকরণ দরকার তাহলো- মোটা বালি, পাথর কুচি, জলজ উদ্ভিদ, ফিল্টার, এয়ার মটর বিশেষ ক্ষেত্রে এয়ার এক্সিকিউটর, এনার্জি বাল্ব, ওয়াটার হিটার এবং রাবারের পাইপ।
পরিবেশ সৃষ্টি : মাছ পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অ্যাকুরিয়ামে পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর এজন্য উপকরণগুলো একেক করে সাজাতে হবে। অ্যাকুরিয়ামে পানি দেয়ার আগে উদ্ভিদ লাগানোর জন্য তলা প্রস্তুত করতে হয়। এক্ষেত্রে মোটা বালি, পাথরের কুচি এবং রঙিন দ্রব্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তলা প্রস্তুত হলে ভেলিসনেনিয়া, সেরাটোফাইলাম, ওয়াটার স্পাইট, অ্যানাক্যারিশ, ঝাঁঝি, জলজ পদ্ম, শাপলা এসবের যে কোনো উদ্ভিদ রোপণ করতে পারেন। এগুলো শুধু শোভাবর্ধনই নয়, এর উপকারিতাও আছে। মাছের বর্জ্য থেকে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে পরিবেশ অনুকূূলে রাখে। সব কাজ শেষে পরিষ্কার পানি দিয়ে অ্যাকুরিয়াম ভর্তি করতে হবে। সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণের জন্য অ্যাকুরিয়ামে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। তাই প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা করে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হবে।
বাহারি মাছ : বাহারি মাছের অধিকাংশই বিদেশি। এ ধরনের মাছের মধ্যে গোল্ড ফিশ অনন্য। ওরা শান্ত প্রকৃতির হয়। দেহের গঠন অনুযায়ী গোল্ড ফিশ দুই ধরনের। লম্বা ও ডিম্বাকৃতি। এগুলো হলোÑ রুইকিন, ওয়াকিন, জাইকিন, কমেট, ওরান্ডা, ফান্টাইল, রানচু, ব্লাক মোর, ভেইল টেইলসহ আরো শতাধিক। অন্য মাছের মধ্যে অ্যানজেল, টেট্রা জেব্রা, এলিফ্যান্ট নোজ, ক্যাট ফিশ, সাকিং ক্যাট, সিলভার শার্ক, রেইনবো শার্ক, টাইগারশার্ক, এলবিনো শার্ক, টেলিচো, অস্কার, ফ্লাওয়ার হর্ন, হাইফিল নোজ, ব্লাক গোস্ট, ব্লু আকারা, ব্লু গোড়ামি, রোজি বার্ব, টাইগার বার্ব, ফাইটিং ফিশ, সোর্ড টেইল, ব্ল্যাক মলি, গ্লাসফিশ, টাইগার বাথ, রেইনবো অন্যতম। আর দেশি প্রজাতির মধ্যে রয়েছে খলিশা, পুঁটি, চান্দা, মলা, পটকা, টেংরা, বেলে, কৈ, চিংড়িসহ ছোটজাতীয় মাছ। এক সময় থাইল্যান্ড, চীন, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশ থেকে মাছের পোনা আমদানি হতো। এখন অধিকাংশ পোনা এদেশেই উৎপাদন হয়।
মাছের খাদ্য : মাছের ওজনের প্রায় ৫% হারে সকাল বিকাল দুইবার খাবার দিতে হয়। এজন্য শুকনো টিনজাত, প্যাকেটজাত এবং প্রাকৃতিক খাবার রয়েছে। শুকনো খাদ্যের মধ্যে আছে আটা, ময়দাসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের মিহি গুঁড়া। টিনজাত খাবারের মধ্যে সিদ্ধ নরম সবজি, চিংড়ি, লবস্টার, বিভিন্ন প্রাণীর হৃৎপি-, যকৃত, কিডনি এবং ডিমের কুসুম। আর প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন-এককোষী প্রাণী, কেঁচো, প্লাংকটন, লার্ভা ও টিউবিফেক্স। এছাড়া বাজারে কৃত্রিম খাবারও পাওয়া যায়।
অন্যান্য : অ্যাকুরিয়ামে বায়ু সঞ্চালন অত্যাবশ্যক। তাই কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। অ্যাকুরিয়ামের সৌন্দর্য বাড়াতে এর তলদেশের মাটি দিয়ে পাহাড়, পর্বত, নালা এসব তৈরি করা যায়। এছাড়া শামুক কিংবা ঝিনুকের খোল অথবা চীনামাটির টুকরো দিয়েও সাজাতে পারেন।
পরিচর্যা : মাছের স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি বজায় রাখতে নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। এর অবহেলায় মাছের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। পানির রঙ ঘোলাটে, লাল বা সবুজ বর্ণ কিংবা গন্ধ বের হলে সাথে সাথে পরিবর্তন করা উচিত। এ কাজ সপ্তাহে একদিন করলে ভালো হয়। প্রথমে মাছগুলো একটি পানির পাত্রে রাখতে হবে। এরপর একটি লম্বা রাবারের পাইপ অ্যাকুরিয়ামের তলদেশে রেখে মুখ দিয়ে একটু বাতাস টেনে ছেড়ে দিয়ে নিচে রাখা খালি বালতি বা পাত্রে পানি রাখতে হবে। এরপর পুনরায় পরিষ্কার পানি দিতে হবে। পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে পুকুর কিংবা নলকূপের পানি ব্যবহার করা যাবে। তবে আয়রনের পরিমাণ বেশি হলে পানি অবশ্যই ফুটিয়ে ঠা-া করে ছেঁকে নেয়া উচিত। পানিতে অ্যাকুরিয়ামসল্ট মিশানো উত্তম। শীতে অ্যাকুরিয়ামের পানি সাধারণত ঠা-া থাকে। তাই এ সময় ডুবন্ত হিটার ব্যবহার করতে হবে। অ্যাকুরিয়ামে পাথর কুচির নিচে ওয়েটডাস্ট ফিল্টার স্থাপন করতে হয়। এর সাথে এয়ার এক্সিকিউটর রাখতে হবে। এর মাধ্যমে যখন বাতাস বের হবে তখন ঊর্ধ্বচাপের সৃষ্টি হবে। ফলে ময়লাগুলো ধীরে ধীরে ফিল্টারের নিচে জমা হবে। এজন্য যন্ত্রটি সবসময় চালু রাখা দরকার।
রোগ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার : অন্য মাছের ন্যায় বাহারি মাছেও রোগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই অ্যাকুরিয়ামকে সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। এজন্য ফরমালিন, ডেটল, সেভলন, লবণ এসব ব্যবহার করতে পারেন। তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। যদি রোগ হয়েই যায় তখন চিকিৎসা জরুরি। অ্যাকুরিয়ামে পালিত মাছে যেসব রোগ হতে পারে; এর মধ্যে লেজ পচা, অ্যাঙ্কর, কোষ্ঠকাঠিন্য, সাদা দাগ রোগ অন্যতম। এসব রোগের লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার একেক করে দেয়া হলো-
লেজ পচা রোগ : অ্যাকুরিয়ামে পালিত মাছের মধ্যে লেজ পচা রোগ বেশি হয়। ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। তবে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের প্রকোপ বেশি। প্রথমে লেজ কিংবা পাখনায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পরে লেজ আস্তে আস্তে পচন ধরে। প্রতিকার হিসেবে অক্সি সাইক্লিন গ্রুপের যে কোনো ওষুধ প্রয়োগ করলে উপকার পাওযা যায়। তবে আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে টেট্টাসাইক্লিন ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি ক্যাপসুলের ভেতরে থাকা পাউডার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ওষুধ ব্যবহারের পর অ্যাকুরিয়ামের পানির রঙ হলুদ অথবা লালচে বর্ণ, সেসাথে পানির ওপর ফেনা জমতে পারে। এতে কোনো ক্ষতি নেই। শুধু ফেনা সরিয়ে ফেললেই হবে।
অ্যাঙ্কর : মাছের পেটের নিচে পাখনার কাছাকাছি কিংবা লেজের আগের অংশে লাল ফুসকুরি দেখা যায়। পরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এরপর ওখান থেকে গাছের শিকড়ের মতো বের হয়। প্রতিকার হিসেবে লেজ পচা রোগের ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে কয়েক দিনের মধ্যে আক্রান্ত মাছ সুস্থ হয়ে যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ : এ রোগে মাছের পেটে গ্যাস হয়ে ফুলে যায়। খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মলত্যাগে অসুবিধা হয়। প্রতিকার হিসেবে খাবার পরিবর্তন জরুরি। সাধারণত বাজার থেকে কেনা লাল ও সবুজ রঙের দানাদার খাবার পরিবর্তন করে খাওয়াতে হবে। খাবার হিসেবে জীবন্ত ওয়ার্ম এবং কৌটাবদ্ধ মৃত ওয়ার্ম (প্রক্রিয়াজাতকৃত) ব্যবহার করলে ভালো হয়।
সাদা দাগ রোগ : এ রোগ হলে মাছের শরীরে সাদা দাগ দেখা যায়। এক ধরনের পরজীবীর কারণে এ রোগের সৃষ্টি। এর আক্রমণ শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। এমনকি মাছ মারাও যেতে পারে। প্রতিকার হিসেবে আলাদা একটি পানির পাত্রে পরিমাণমতো ফরমালিন এবং ক্লোরাইড সল্ট মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় গোসল করাতে হবে। এ কাজ সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত দিনে দুইবার করতে হবে।
অ্যাকুয়ারিয়াম পরিষ্কার রাখা এবং পানি পরিবর্তন করাকে কেউ কেউ ঝামেলা মনে করেন। আসলে এ কাজের জন্য সপ্তাহের ছুটির দিনই যথেষ্ঠ। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছেশক্তি এবং কিছুটা সময় বের করে নেয়া। এর ফলাফল দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ, সেসাথে মনের প্রশান্তি। এমন সুযোগ হতে আমরা যেন বঞ্চিত না হই।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করি
সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ি।
মৎস্য বাংলাদেশ ওয়েব সাইটির সাথে থাকতে ই-মেইল ঠিকানা লিখুন।
স্বত্ব © ২০২১-২২ মৎস্য বাংলাদেশ সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত।